Skip to main content

সন্ধ্যা আসন্ন। নদীর জলে অস্তমিত সূর্যের শেষ আলোর তরল স্পন্দিত রূপ। মন্দ বাতাস শিরীষ ফুলের গন্ধে প্রমত্ত।

কবি বিষন্ন। তাঁর সৃষ্টি অজস্র। দেশে দেশে বন্দিত তিনি। প্রাতঃস্মরণীয়। কি বিচিত্র ধারায় তাঁর কাব্যপ্রতিভা প্রবাহিত - সমালোচনার ঊর্দ্ধে তাঁর কাব্যপ্রাসাদ। এ সর্বজনস্বীকৃত।
তবু কেন এ ক্ষোভ? তাঁর বুকের ভিতর ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ক্ষোভ আজ দাবানলপ্রায় হয়ে উঠছে। তাঁর হুতাশনের বাতাস সে আগুনকে করছে চঞ্চল। আজ তিনি বাধা দেবেন না। আজ এ ক্ষোভের মুখোমুখি তাঁকে হতেই হবে। এ বিশ্বসংসার না জানুক, তিনি তো জানেন, যা লিখতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন কি? না না না। হা ঈশ্বর! এ মান, এ খ্যাতি শুধুই আত্মপ্রবঞ্চনা।
তাঁর পলাশপত্রের মত দুই চোখ থেকে নামল জলের ধারা। বুকের ভিতর থেকে সব দীর্ঘশ্বাস একসাথে কান্নার আর্তনাদে আছড়ে পড়ল সন্ধ্যাকাশ ভেদ করে। ঘরে ফেরা পাখির দল উঠল চমকে।
হা ঈশ্বর! হে করুণাময়! হে দীনবন্ধু!

বৎস!

কে ডাকল? কবি চমকে চাইলেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শ্বেতশুভ্রবসনাবৃত এক ঋষি। কি অপূর্ব তাঁর রূপ, তাঁর আভা। সমস্ত সন্ধ্যা যেন বন্দনায় হল নত।
কবি সাষ্টাঙ্গে করলেন প্রণাম। তাঁর যে অশ্রু ছিল দিশাহীন, তা ঋষির চরণে পেল গতি। তিনি কবির মাথায় হাত রেখে বললেন, শান্ত হও বৎস। বোসো।
কবির পাশে কুশাসনে বসলেন ঋষি। সান্ধ্যসূর্য যেন স্থির হল। নদীর কল্লোল হল শান্ত। তরু, মাটি, আকাশ, বাতাস, কীটপতঙ্গ সকলেই হল স্থির, উৎকর্ণ। সময় দাঁড়াল চলার বেগ থামিয়ে।
ঋষি শান্ত, মধুর কণ্ঠে বললেন, হে কবি, আমি জানি তোমার ব্যাথা।
কবি নতমস্তকে রইলেন ঋষির চরণের দিকে চেয়ে।
ঋষি বলে চললেন-
তুমি কবি। রচনা করেছ বহু গাথা। ন্যায়, নীতি, ধর্ম, তত্ত্ব। নরনারীর সুখ দুখ, বিরহ মিলন। প্রকৃতির শোভা তোমার বর্ণনায় হয়েছে রোমাঞ্চকর। রচনা করেছ পরমেশ্বরের স্তব।
ঋষি থামলেন। গভীর শ্বাস নিলেন। বললেন, তবু এ অসম্পূর্ণ।
কবি বিস্মিত হয়ে ঋষির সৌম্য মুখমণ্ডলে চাইলেন। তার মন শান্ত কিঞ্চিৎ। আবার চাইলেন মাটির দিকে, যে মাটি স্পর্শ করে আছে ঋষি চরণযুগল।
ঋষি বললেন, মূল সত্যের হয়নি বর্ণনা তোমার রচনায়।
কবি হলেন চমৎকৃত। বললেন, কি সে সত্য প্রভু?
ঋষি বললেন, মাধুর্য। পরমানন্দের যে মাধুর্য মানবচিত্তের গহনকুঞ্জে, তা তোমার রচনায় রয়ে গেল অধরা। তাই তুমি ক্ষুন্ন, বিষন্ন, অসম্পূর্ণ।
কবির চিত্ত হল উদ্বেল। তিনি ঋষিচরণে মস্তক রেখে কেঁদে উঠলেন শিশুর মত। বললেন, আরো বলুন প্রভু, আরো বলুন। বলুন সে মাধুর্যলীলা আমার কানে। আমি অধম, দাম্ভিক, অন্ধ। তাই এ সত্য রইল অধরা প্রভু। বলুন, কৃপা করুন।
ঋষি বললেন, ধৈর্য্য ধরো বৎস। বলছি সবিস্তারে।
প্রভুর বিভব প্রতিটা কণায় এ সংসারে। তাঁর অস্তিত্বে এ জগতের অস্তিত্ব। তাঁর 'হাঁ' তে সৃষ্টি, তাঁর 'না' তে ধ্বংস। তবে এ শুধুই তাঁর ঐশ্বর্য। এ বাহ্যিক। এ মহিমা মধ্যাহ্নসূর্য্যের ন্যায় অনাবিষ্কৃত, রহস্যমন্ডিত অনন্তকাল। এর প্রতি তোমার স্তব হয়েছে রচিত। নরনারী দূর থেকে গেয়েছে গান, এনেছে অর্ঘ্য মণিমানিক্য। এনেছে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়। করেছে প্রণাম।
প্রভু চাননি তা। তাঁর যে মাধুর্য, সুখে দুখে সম্পদে বিপদে মানুষের চিত্তে সান্ত্বনা হয়ে এসেছে, প্রেমের বাঁশিতে নন্দনলোকের সুর বাজিয়েছে, হাতের উপর রেখেছে আশ্বাসের হাত - তাকে করো উদ্বোধন। প্রভু আসুক দেবালয় ছেড়ে হৃদিমন্দিরে। প্রেমের অভিষেক হোক অশ্রুতে, ভক্তিতে, অনুরাগে। তিনি রথে নেই, তিনি আসুন পথে। ধূলা লাগুক তাঁর পায়। নরনারী তাঁকে বন্ধু বলে চিনুক, বঁধু বলে বরণ করুক। ভয় যাক। প্রেম আসুক। স্তব যাক। বিরহ মিলনের সংগীত আসুক।
বোলো না এ সংসার মিথ্যা, মায়া। বলো এ তাঁর মাধুর্যনিকেতন, যদি মধুর পরমানন্দের পাও সন্ধান। সে বাড়িয়েছে দক্ষিণ হাত তোমার চিত্তে। এবার তুমি বাড়িয়ে দাও সে হাত। রচনা করো তাঁর মাধুর্যলীলা।

 

ভোর হল। কবির সারা দেহমন আপ্লুত নবজাগরণে। আকাশে বাতাসে গুঞ্জরিত অলির কূজন। বাতাসে মধুগন্ধ। কবি হলেন রচনায় নিমগ্ন।


(শ্রীমদ্ভাগবতের অনুষঙ্গে লেখা)