Skip to main content

আজ এক খুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে গল্প করতে করতে বলল, আজকে আমি ক্রিম দেওয়া বিস্কুট খেয়েছি....জানো তো, আমি যখন স্কুলে যেতাম, তখন মা টিফিনবক্সে আমায় এই বিস্কুটটা মাঝে মাঝেই দিত..

    আমরা যখন স্কুলে যেতাম.... কথাটা খুব স্বাভাবিকভাবে বলার ধরণের জন্যেই যেন বিঁধল। ওর পরের কথাগুলো আর শুনতে পাচ্ছিলাম না। সবটা কত সহজে বাচ্চাগুলো মেনে নিয়েছে। টিভি চালালে খ্যাতনামা সব মনোবিদেরা হাজারো একটা বিষয়ে আলোচনা করেছেন, শুনেছি। কিন্তু ব্যস, ওইটুকুই? আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো আগে যে অনুষ্ঠানগুলো 'ছুটিছুটি' নামে করত, এখন সেগুলো করা খুবই দরকার বলে আমার মনে হয়। বাচ্চাগুলোর কথা ভাবুন। এত এত মিডিয়ায় ওদের জন্যেও অনেক অনেক কিছু করার দায়িত্ব বর্তায়। বাচ্চাগুলোর জন্য এই পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে কিছু তৈরি হোক না। সিনেমা, কার্টুন, গান, গল্প বলা এরকম নানা কিছুর মাধ্যমে কাজটা এগোক। শিক্ষা কি শুধু এক উপায়েই হয়? আজ সাধারণ রাস্তাগুলো যখন বন্ধ, তখন অন্য উপায়ে কাজটা হোক। এটা মাথায় রাখতে হবে বাচ্চাগুলো এই দুঃসময়ের শাস্তিটা পাচ্ছে, কিন্তু কারণটা অনুভব করতে পারছে না। এর জন্যে ওদের মানসিক অবস্থাটাও স্বাভাবিকত্ব হারাচ্ছে। এমনিতেই আমরা যে যুগের মধ্যে দিয়ে কোভিডের আগেই যাচ্ছিলাম সেই সময়ে বাচ্চাদের মধ্যে অ্যাগ্রেসিভনেস, ডিপ্রেশন, একাকীত্ববোধ অনেক বেশি ছিল। তার উপরে এই সংকটময় মুহূর্ত। এই সময়ে তারা কি করবে বলুন তো? আপনারা বাড়িতে সব সময় টিভিতে খবরের কাগজে, স্মার্টফোনে করোনার ভয়াবহতার সরব সাক্ষী হচ্ছেন। সারাদিন উদ্বিগ্নতাকে বাড়ির আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রাখছেন। বাচ্চাগুলোর অবস্থাটা একবার ভাবুন। তারা কোনো স্পেসই পাচ্ছে না। সমস্ত মিডিয়া বড়দের হয়ে বসে আছে। যেন ওদের কোনো অস্তিত্বই নেই। তাদের আলোচনা একটাই তাদের পড়াশোনার কি হবে। কেন তাদের অস্তিত্বে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নেই? তাদের মনটা বুঝতে চেষ্টা করব না? তাদের এই পরিস্থতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলতে সাহায্য করব না? শুধুই আতঙ্কের কথা বলব, আলোচনা করব, এতো বড় অত্যাচার।

    আমার বলায় কিছু আসে যায় না জানি। তবু আমার মনে হয় আমাদের এই এত এত মিডিয়ার এটা দায়িত্ব যে বাচ্চাদের জন্য এই সময়ে আলাদা করে কাজ হোক। আর আপনারা যারা অভিভাবক, তাদের কাছে আমার অনুরোধ বাচ্চাগুলোর মনের মধ্যে আপনার প্যানিক ছড়িয়ে যেতে দেবেন না। আমি আমার এত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বাবা-মায়েরা নিজেদের উদ্বিগ্নতার স্বভাবটা উত্তরাধিকারসূত্রে নিজেদের সন্তানদের মধ্যে দিয়ে যান। আর সেই স্বভাবটা তাদের অচেতন মনে এত গভীরে দানা বাঁধে যে সারাটা জীবন তাকে একপ্রকার মানসিক পঙ্গু করে তোলে। একটা ছ বছরের বাচ্চাকে শুনেছি বলতে, এটা খাব না, এটা খেলে আমার অ্যাসিড হবে। আমি তাজ্জব বনে গেছি। অ্যাসিডের মানে ও কি বোঝে? কিচ্ছু বোঝে না, কিন্তু আতঙ্কটা বোঝে। ও জানে আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতা কি জিনিস। এটা এত এত বাচ্চার মধ্যে আজকাল খেয়াল করছি যে ভাবি এই অকালবার্ধক্য আনা জীবনগুলোর ভবিষ্যৎ কি হবে?

    আমি তাই আবারও অনুরোধ করছি আপনাদের, বাচ্চাগুলোকে পরিণত করে গড়ে তোলার নাম করে ওদের শৈশবটা কেড়ে নিয়ে ওদের অকালবার্ধক্যর দিকে ঠেলে দেবেন না প্লিজ। ওদের পজিটিভ দিকটা দেখতে শেখান। এই দুঃসময়েও মানুষ কতভাবে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সেইগুলো নিয়ে গল্প করুন। কতজন অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে, কতজন বেড না পেয়ে মারা যাচ্ছে, ভ্যাক্সিন পেয়েও মারা যাচ্ছে - এইসব আলোচনা করে করে ওদের মনগুলোকে বিষিয়ে তুলবেন না। পারলে একটা সিনেমা দেখুন, Life is beautiful, সিনেমাটা একটা সত্য ঘটনার উপর আধারিত। অস্কার পেয়েছিল। হিটলারের ওই কনসেনট্রেশান ক্যাম্পেও একজন বাবা কি করে তার ছেলেকে সব কিছু অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচিয়ে নানা ভাবে তার মানবিক সত্তাটাকে বাঁচিয়ে রাখছেন, এবং সফল হচ্ছেন।

    আমরাও সেরকম একটা অতিকঠিন সময় দিয়ে যাচ্ছি। কাল কি হবে কেউ জানি না। একটা প্যাণ্ডেমিকের সময় শুধু নিজের চেষ্টায় নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায় - এ ধারণা পাগলামি। ভাগ্যের হাতেও অনেকটা থেকেই যায়। অগত্যা এত প্যানিকড না হয়ে আসুন বাচ্চাগুলোর শৈশবকে রক্ষা করার ব্রতী হই। যেভাবে যার দ্বারা যতটা সম্ভব। এইভাবে ওদের শুধু পরীক্ষা আর পড়াশোনার সামগ্রী না করে একজন ক্রম বিকাশমান মানুষ হিসাবে দেখি। আমাদের অনেক দায়িত্ব ওদের উপর। আমাদের মিডিয়া না হয় লোভের দাসত্বে বিকিয়ে আছে, ওদের নিয়ে ওদের জন্য কাজ করার সময় তাদের নেই। কিন্তু আমরা নিজেরাও কি পারব না? একটা অসুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বানিয়ে যাব নিজেদের অবহেলায়? তাই কি হয়? মুখ দেখাব কি করে তবে?