মেয়েটার বয়েস হবে বাইশ কি তেইশ। ছেঁড়া ছেঁড়া হালফ্যাশানের জিন্স, সাদা টিশার্ট গায়ে, টিশার্টে দুটো বেড়ালের ছবি, নাকে নথ, চুলটা একদিকে এলিয়ে পড়ে আছে, চুলের আগার দিকটা নীলাভ, স্ট্রিট লাইটের আলো পড়ে চকচক করছে।
সন্ধ্যের ব্যস্ততা। চারদিক দোকানের আলোয় ঝলমল করছে। শপিংমলের পর শপিংমল, কফিশপ, গয়নার দোকান, চশমার দোকান, জামাকাপড়ের দোকান ইত্যাদি ইত্যাদি রাস্তার দুধারে। রাস্তায় মুহূর্মুহু গাড়ি। সেই রাস্তা পেরিয়ে মেয়েটা আসছে, হাতটা এক বৃদ্ধার হাতে ধরা। বৃদ্ধা স্থূলকায়, গলার কণ্ঠি, মেয়েটার হাতটা নিজের আরেক হাতে ধরে টলমল পায়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। প্রচণ্ড ঢেউয়ের দোলা পার হয়ে যেন নৌকা ভিড়তে চাইছে পাড়ে, দক্ষ মাঝির উপর ভার দিয়ে।
এ পারে এল। মেয়েটার চোখে কাজল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। মেয়েটা বৃদ্ধাকে বলল, এবার চলে যেতে পারবেন তো?
এতক্ষণ ভাবছিলাম নিজের ঠাকুমা হয় তো। তা নয় তবে? মেয়েটা তাকালো আমার দিকে। সোজাসুজি তাকিয়ে আছি যে! আমার অন্যদিকে তাকানো উচিৎ। তাকালামও, কিন্তু আবার ফিরে তাকালাম তার দিকে। বৃদ্ধা তার হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলছেন, ভাগ্যিস এলে মা…চোখে দেখি না ভালো…. ছেলেটা বাইরে কাজ করে, বউমা পড়ায় এই সময়…. তুমি কোথায় যাবে মা?
মেয়েটা বলল, হালিশহর…. আপনি পারবেন তো যেতে…..
বৃদ্ধা চশমাটা ঘেমে যাওয়া নাকের গোড়ার দিকে আরেকবার তুলে বললেন, পারব মা…. তুমি কি বাস ধরবে তো?
মেয়েটা বলল, হ্যাঁ।
আমি তাকিয়েই আছি। কত দূরের দুটো প্রজন্ম। সময়ে, বিশ্বাসে। তাও একে অন্যের হাত ধরে রাস্তা পার করে দিতে পারে। অচেনা লাগে না।
মেয়েটা গিয়ে বসল, বাসস্ট্যান্ডে। ঘড়ি দেখলাম, প্রায় পৌনে ন'টা। বসে আছে পঁচাশি নাম্বার বাসের জন্য। আমার কাজ শেষ হয়নি। দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাসে যাওয়ার নেই। তাও বাসের অপেক্ষা করছি। রাত হচ্ছে। বৃদ্ধা মিলিয়ে গেল ভিড়ে। মেয়েটা বসে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। রাস্তায় এরকম মেয়েদের দেখলে নানারকম নামে ডাকে। “পিঙ্ক” সিনেমাটা মনে আছে না? ক্যারেক্টর ডিফাইন করা খুব কঠিন কিছু না আমাদের কাছে। একটা সেক্স অবসেসড সমাজ বাইরে শুদ্ধ-অশুদ্ধতার বালাই নিয়ে রাতদিন কাটাকুটি খেলে যাচ্ছে। কাউকে না কাউকে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ কেটেই চলেছে।
মেয়েটা সিগারেট ধরালো। আশেপাশের লোকেদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার অদ্ভুত তেজ মেয়েটার চোখে। কী একটা নির্লিপ্ততা। ক'টা মানুষ বিশ্বাস করবে মেয়েটা এই খানিক আগেই একজন অসহায় বৃদ্ধাকে রাস্তা পার করিয়ে দিল অনেক যত্নে? বিশ্বাস করবে না। কয়েকটা নোংরা গল্প বিশ্বাস করবে। অভ্যস্ত নীতিবোধের প্যাটার্নের সঙ্গে খাপ খাবে। স্বস্তি পাবে নিজের শুদ্ধতার উচ্চ আসনের তৃপ্তিতে।
আমার কাজ শেষ। ফিরতে হবে। ওর বাস আসেনি এখনও। এসে যাবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বাসটা যেন ইচ্ছা করে দেরি করছে, মেয়েটাকে রাতে নামিয়ে দিয়ে হেনস্থা হতে দেওয়ার ছক কষছে। ভুল ভাবছি। কিন্তু এটাই মনে হচ্ছে।
মেয়েটা সাবধানে ঘরে ফিরুক। সে বৃদ্ধাও সাবধানে ঘরে ফিরুক। সবার একটা ফেরার ঘর থাকুক।