ছাত্রের মন উদাস। জিজ্ঞাসা করলাম, কী হল?
বলল, স্যার ভীষণ লস হয়ে গেল। বাবা মা তোমরা ঠিকই বলো... ভীষণ বুদ্ধি কম আমার!
বুঝলাম বিষয়টা গুরুতর শুধু না, গুরুত্বপূর্ণও। নইলে এমন গভীর আত্মোপলব্ধি সবার জীবনে সব সময় তো আসে না।
বললাম, আমায় বলা যাবে?
সে বইটা বন্ধ করে বলল, অবশ্যই। তবে আপনি অতটা বুঝবেন না.... তাও বলি.... আমার গার্লফ্রেন্ড ব্রেক আপ করে দিল।
ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ অভিঘাতের দলিল সেই আদিকালের নিয়েনডারথাল যুগ হয়ে বিদ্যাপতি-খৈয়াম হয়ে আধুনিক বলিউড অবধি। কিন্তু আরো কিছু আছে কী?
বললাম, কিন্তু এ তো হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। এর সঙ্গে বুদ্ধির কী সম্পর্ক তো ভাই বুঝলাম না।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমন তাকালো আমার দিকে, যেন নার্সিংহোমের বেডে শোয়ানো টাওয়েলে জড়ানো সদ্যজাত শিশুকে দেখছে। অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইলাম কী বলে শোনার জন্য।
বলল, স্যার এক একবার পার্কে ঢুকতে কুড়িটাকা করে নেয়। হিসাব করে দেখলাম, আমার সব মিলিয়ে দুশো টাকা খরচ হয়ে গেছে। (দীর্ঘশ্বাস ও বিরতি।) এর চাইতে যদি আমি তিরিশ টাকার চার কিনে মাছ ধরতাম আমার ওর থেকে বেশি টাকার মাছ বিক্রি হত বাজারে!
কগনিটিভ ডিসোনেন্স আর কাকে বলে! প্রেম, পার্ক... এ দুটো ছবির সঙ্গে আচমকা মাছের চার, বাজারের থলে.... মানে কী যেন হচ্ছে। প্রেমে আঁশটে গন্ধ থাকাটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু প্রেমের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচারে মাছের দরদাম....
মানে তুই কী মাছ ধরিস? জিজ্ঞাসা করলাম। খুব নম্র হয়ে, যাতে কোনো শখ বা প্রফেশানের প্রতি আমার হীনবিচারের আশঙ্কা আবার প্রকাশ না পেয়ে বসে। আজকাল সত্য বিচারবুদ্ধি অনুভবের চাইতে বাজারের মাপের সঙ্গে মিলিয়ে বলা চল।
সে বলল, আরে ওই নিয়েই তো অশান্তি.... আমার ইচ্ছা মাছের ব্যবসা করব....আমার মাছ ধরতে হেব্বি লাগে স্যার...... তা ওর ওসবে আপত্তি... আমাকে নাকি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে... .কেন?.... মাঝখান থেকে গেল আমার দুশো টাকা......
বাঙালির মৎস্যপ্রেম জানি। এ হেন উদাহরণে সে বিশ্বাস আরো বাড়ল, সেও মানি। কিন্তু প্রেমের হাত পিচ্ছিল মাছ ছাড়িয়ে নিল.....
চণ্ডীদাস লিখছেন শ্রীকৃষ্ণ বৃষ্টিতে ভিজছেন শ্রীরাধার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে..... রাস্তায়.... লুকিয়ে এসেছেন.... হয় তো তাড়াহুড়োতে ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছিলেন..... কিম্বা হয় তো বিদ্যাপতির পদানুসারে.... "বরষার ছতরি" পিয়া ভেবেই এসেছেন..... আর ওদিকে শ্রীরাধা ছটফট করছেন কী করে ননদ ইত্যাদিকে এড়িয়ে যাবেন। আচ্ছা এই ছটফটানি ছেড়ে যদি শ্রীরাধা বাড়ির কোনো বিশ্বস্ত কাজের লোকের হাতে চারটে মাছভাজা পাঠিয়ে বলতেন, ও কমলির মা, ওকে বলিস এমন না ভিজতে, আজ তো বেরোতে পারব না…. খিচুড়ি আর মাছভাজা ছেড়ে ওই বনে-বাদাড়ে গিয়ে কী হবে বল….. ওকে বল যাওয়ার সময় দুটো সর্দি-জ্বরের ওষুধ নিয়ে যেতে। আমি পরে খোঁজ নেবখন।
হয়! এমন ভাবাও অসাধ্য!
যা হোক। সে ছাত্র বাড়ি যাচ্ছে। আমি দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে খুব হীনমন্যতার সঙ্গে বললাম, তা আমি বুঝব না বললি কেন?......
স্যার… আপনি তো প্রেমটেম… সংসার-টংসার করলেন না…. ওদিকে মাছও খান না শুনেছি….. কী করে বুঝবেন…..
মনে ঠেক লাগল। মাছের গন্ধ সয় না এ সত্যি। কিন্তু প্রেম? ওরে সব প্রেম কী আর শিয়ালদা কৃষ্ণনগর লোকালের মত পাড়া কাঁপিয়ে হামহুম দুড়দাড় করে যায় রে পাগল….. কিছু প্রেম তো তিলোত্তমা কলকাতার বুকের তলা দিয়েও যায় সবার অলক্ষ্যেই যায়….
সে ফিরছে। দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, মাছের ব্যবসায় ভালো লাভ না?
হা হতভাগ্য আমার…. ওরে জেন জেড….. এই আষাঢ়ের কৃষ্ণকালো মেঘের তলায় দাঁড়িয়ে…. ফিল লাইক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে…. এ কী কথা বললি?.... ভগ্নহৃদয় প্রেমিক কিনা মেঘদূত ভুলে মীনব্যবসার লাভালাভে ডুবে…. আজ যদি থাকতেন চণ্ডীদাস কী বিদ্যাপতি রে….. কবিত্ব ভুলে রণংদেহি ক্ষত্রিয়ের মত কচি বাঁশপেটা করত….. যা ভাগ!