মাছের বাজারে গিয়ে বুঝলেন গন্ধবোধটা তো একেবারে গেছে! এইবার?
এক একটা মাছ এনে এনে নাকের কাছে ধরেন, শোঁকেন, রাখেন, ঘামেন, আবার মাছ ধরেন, তোলেন, শোঁকেন, ঘামেন, রাখেন।
বাজারটা ভালোই বসে গেছে, দেরি করেই এসেছেন। আজ সকালে হাতে সাবান দিতে দিতেই আধঘন্টা হল। হবে না? প্রথমে হাতে সাবান দেন, তারপর হাতে সাবান লেগে আছে বলে জল দিয়ে ধোন, তারপর আবার জল লাগল বলে সাবান দেন, আবার সাবান লাগল বলে জল দেন, আবার জল লাগল বলে..... যতক্ষণ না ট্যাঙ্কের জল শেষ হয়। আজ কপাল ভালো ছিল তাই আধঘন্টার মধ্যেই শেষ হয়ে গেল জল।
কিন্তু গন্ধ পাচ্ছেন না কেন? বাজারের ব্যাগ নিয়ে গাছতলায় দাঁড়ালেন। বসা যাবে না। যা নোংরা। জ্বর তো নেই। পেট খারাপও নেই। দুর্বলতাও নেই। তবে? একেই বলে অ্যাসিম্পটোমেটিক করোনা? তাই বা কি করে হয়? গন্ধই তবে পাচ্ছেন না।
সিগারেট ধরালেন। কি আশ্চর্য, সিগারেটের গন্ধ তো পাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ফেলে বাজারের দিকে আবার ছুটলেন। আড়চোখে নিভন্ত সিগারেটটার দিকে তাকালেন। এত কটা টাকা! ছি ছি। নিজেকে ধিক্কার দিলেন। আজ আর সিগারেট খাওয়া যাবে না। কিন্তু কি আশ্চর্য মাছের গন্ধ আবার পাচ্ছেন না তো? সব্জীর দিকে গেলেন। পেঁয়াজ, ধনেপাতা হাতে তুলে শুঁকলেন, গন্ধ আছে। কিন্তু মাছের গন্ধ? বাজারে তাকিয়ে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন আর কিসের কিসের গন্ধ হতে পারে? কেউ উনুনে আঁচ দিচ্ছিল, গন্ধ পেলেন। একজন বিড়ি খাচ্ছিল, পাশে দাঁড়ালেন, গন্ধ পেলেন। বাইক নিয়ে ফটফট করে চলে গেল, পোড়া তেলের গন্ধ পেলেন। কিন্তু মাছ?
আবার মাছের বাজারে এলেন। এখনও কিচ্ছু কেন হয়নি। প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। অফিসে যেতে হবে তো নাকি! মাছ কিনলেন। সব্জী কিনলেন। সব গন্ধ পাচ্ছেন, মাছের আর পাচ্ছেন না। বেজার মুখে বাড়ি গেলেন। হাত ধুলেন। কাগজ পড়লেন। হাত ধুলেন। খেতে বসলেন হাত ধুলেন। হাত ধুলেন খেতে খেতে। আবার খেতে খেতে হাত ধুলেন। সব খাবারের স্বাদ পেলেন, গন্ধ পেলেন, মাছের আর পেলেন না। বিমর্ষ মুখে অফিসে গেলেন। কারোর সঙ্গে কথা বললেন না। শুধু তেরো মিনিট অন্তর অন্তর চব্বিশ মিনিট করে হাত ধুলেন। অফিস সেরে বাড়ি ফিরলেন। হাত ধুয়ে, স্নান করে, পোশাক বদলিয়ে, হাত ধুয়ে ছাদে গেলেন। নিজেকে ডুবুরির মত জলের ভিতর চুবিয়ে দিলেন। সমস্ত মাছ সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। ধরা দিচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে ভাসছেন। কল্পনা করছেন। যাকে বলে দিবাস্বপ্ন। জ্বর নেই, কাশি নেই, দুর্বলতা নেই, পেট খারাপ নেই। শুধু জীবনে মাছ নেই। এ হতে পারে? মাছ জন্মেছে কেন? সে তো মানুষ খাবে বলেই। নইলে তার আর কি কাজ আছে? আর সেই কিনা গন্ধ পাবে না? তাও হয়? গন্ধ নেই, স্বাদ নেই।
চোখের কোল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। হাতের কোনা দিয়ে মুছছেন। হাত স্যানিটাইজ করছেন। স্যানিটাইজারের বোতল ধুচ্ছেন। আবার হাত ধুচ্ছেন। হাঁটছেন। কলকাতা শহরটা ছাদে উঠে দাঁড়ালে এই সন্ধ্যেবেলা কি ভালো লাগে। বাগবাজার জায়াগাটাই কি আধ্যাত্মিকতা পূর্ণ। একে বলা হয় গুপ্ত বৃন্দাবন। কত মন্দির আছে! মায়ের বাড়ি, উদ্বোধন পত্রিকার অফিস। কি নেই! কিছু দূরেই গঙ্গা। গঙ্গায় কত মাছ! আহা, উনি কিচ্ছু পাবেন না? আবার কাঁদলেন। হাত স্যানিটাইজ করলেন। স্যানিটাইজারের বোতল ধুলেন। আবার হাত ধুলেন। ছাদের কোনায় এসে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ পকেট থেকে কি যেন একটা লাফিয়ে মাটিতে পড়ল। তাড়াতাড়ি মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখেন, একটা কইমাছ। কি আশ্চর্য, পকেটে মাছ এলো কোত্থেকে রে বাবা! উনি উবু হয়ে মাছটা ধরতে যাবেন, মাছটা তড়াক করে সরে গিয়ে বলল, উঁহু ধরবি না সরখেল, তোর এখন মৎসশাপ লেগেছে।
সরখেল, থেবড়ে বসে বলল, সেটা কি?
কইমাছ ছাদে পায়চারি করতে করতে বলল, মনে পড়ে, একদিন রবিবার সকালে তোর পাশের বাড়ির বউটা ইলিশমাছ রেঁধে তোর বাড়ি দিয়ে গিয়েছিল। তুই কি করলি? সেই ইলিশমাছ পেয়েছিস বলে, তোর বউয়ের শাশুড়ির প্রেমিকের বাগানবাড়ির পুকুরের অমন ল্যাটামাছের ঝোল খেলি না! তোর বউ সেদিন কি দুঃখ পেয়েছিল। সে মনে মনে তোর শ্বশুরের প্রেমিকার কমরেড বাবার প্রসঙ্গ তুলে বলেছিল, "তোমরা মৎসসম্প্রদায়, যে সম্প্রদায়ে স্বয়ং নারায়ণ অবতাররূপ ধারণ করেছিলেন, তোমরা সেখানে এই শ্রেনীবৈষম্য মানবে?"
তার কান্নায় আমাদের মৎসকূলে এক ঘোরতর আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের সামুদ্রিক ব্রিগেডের মিটিং এ ঠিক হল যে তোকে এর শাস্তি পেতেই হবে। তাই তোর এই দশা।
সরখেল সব শুনে স্যানিটাইজার হাতে ঘষে মাথা চাবড়ে চাবড়ে কাঁদতে শুরু করল।
কইমাছ বলল, থাক আর কাঁদতে হবে না। তোর কান্নায় অনুতাপে সব পাপ ঘুচে গেছে। তাই আমি দেখা দিলাম। আজ থেকে আর কইমাছ ছুঁবি না। পাশের বাড়ির বৌটা যদি তিমিমাছের সরষেবাটা রেঁধে আনে তাও ছুঁবি না। তোর ছুঁকছুঁকানি বন্ধ কর। এখন থেকে তুই আবার আগের মত হলি।
এই বলে কইমাছ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দেখতে দেখতে দক্ষিণের হাওয়া দিল। আর চারদিকে ম ম করে মাছের গন্ধ ভরে ভরে উঠতে লাগল। সরখেলবাবু ছাদেই আবেশে শুয়ে পড়লেন। মনে হচ্ছে যেন মৎসসাগরে ডুবে যাচ্ছেন। হাতড়ে শুধু স্যানিটাইজারটা সঙ্গে নিলেন। একা তো যাওয়া যায় না কিনা!