সদ্য আলো ফুটেছে। রোদ ওঠেনি। চায়ের দোকানে বড় উনুনে আঁচ চড়েছে। আরেকটু বেলায় ওতে কচুরি ভাজা হবে। ধোঁয়া উড়ছে। রোজ ওড়ে। যেন সকালকে বন্দনা করার এই এক উপায় দোকানির। স্টোভে চা হয়। বেঞ্চে বসে খগেন মাষ্টার চা খাচ্ছে। দুটো টোস্ট বিস্কুট কাঁচের গ্লাসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। বিস্কুটটা কাঁচের গ্লাসে অর্ধেক ডুবে আটকে যায়। খগেন মাষ্টার একটু অপেক্ষা করে। ভিজে নরম হওয়ার। তারপর হ্যাঁচকা মেরে তুলে কামড় বসায়। ধীরে ধীরে চিবায়। চিবাতে চিবাতে উদাস চোখে তাকায়। কুকুরটা লেজ নাড়ে। অল্প বিস্কুট ভেঙে দেয়। কুকুরটা লালা জড়িয়ে চেটেপুটে খায়। আবার তাকায় খগেন মাষ্টারের দিকে। কিন্তু আরো বিস্কুট দেওয়ার সামর্থ্য কোথায়?
জনার্দন পুরোহিত সাইকেলটা স্ট্যাণ্ড করে মন্ত্র বলতে বলতে একহাতে পুজোর সাজি নিয়ে দোকানে ঢোকে। তার স্নান করা শুদ্ধ শরীরে ঈশ্বরের আদর আদর গন্ধ। কপালে চন্দনের তিলক। একগাল হেসে তাকায় খগেন মাষ্টারের দিকে। কথা বলে না। মন্ত্র আওড়িয়ে চলে। দোকানের ভিতরে ঢোকে ধোঁয়া ঠেলে। আর দেখা যায় না। অন্ধকারে দোকানের ভিতর থেকে মন্ত্রোচ্চারণ কানে আসে। আর বিমলের মায়ের বাসনকোসন মাজার আওয়াজ। বিমলের মা এ দোকানে কাজ করে ষোলো বছর।
জনার্দন বেরিয়ে আসে। একহাতে সাজি। একহাতে সাইকেলের স্ট্যাণ্ড তুলে সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দেয়। ভোরের রাস্তায় সাইকেল গড়িয়ে চলে, যেন রথ চলেছে। ঈশ্বর অপেক্ষা করে আছেন দোকানে দোকানে জনার্দনের জন্য।
পরেশ দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বলে, মাষ্টার ভালো তো?
পরেশের গায়ে কীসের যেন গন্ধ, খগেন মাষ্টার বুঝে পায় না। ভালো লাগে, কী না লাগে সেটাও বুঝে পায় না। এ দোকানের আসল মালিক পরেশ। বয়েস হয়েছে ষাটের কোটায়। পরেশ হাসে না। পরেশ তাকায়। তার চাহনিতে যেন চালুনি আছে। ছেঁকে নেয় সংসারে যা কিছু লাভের। বাজারে দোতলা বাড়ি। নাতিপুতি নিয়ে ভরা সংসার। খগেন মাষ্টার গেছে কয়েকবার।
======
দুটো চারাপোনা দিয়ে, আর অল্প মুসুরের ডাল দিয়ে দু মুঠো ভাত খেয়ে খগেন বসে আছে বাড়ির বাইরে। এক চিলতে বারান্দায়। এ গলিতে রোদ ঢোকে না। ভদ্র মানুষও ঢোকে না। এ গলির মুখ থেকে শুরু হয় নষ্টপাড়া। এই নষ্টপাড়ার মাষ্টার মশায় খগেন। বয়েস পঞ্চান্ন ছুঁয়েছে গেল আশ্বিনে। কিন্তু চামড়ার রঙ চটে, রোগাটে শরীরটা দেখলে মনে হয় সত্তরটা বসন্তের রাত নিঃস্ব করে গেছে খগেনকে।
খগেনের সংসার হয়নি। খগেনের জন্ম এ পাড়ায়। ভালো মানুষের সংসারে ঢোকার সুযোগ হয়নি খগেনের। একটা ক্লাব থেকে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য খগেনকে দায়িত্ব দিয়েছিল। খগেন সে দায়িত্ব পালন করেছে পঁচিশটা বছর। তারপর ক্লাব উঠে গেল। পার্টি বদলে গেল। খগেন মাষ্টার রয়ে গেল, কিন্তু স্কুলটা উঠে গেল।
খগেনের ওই এক চিলতে বারান্দায় দুটো টব। একটাতে নয়নতারা গাছ। আরেকটা জবা। ঘরের মধ্যে একটা তাকে কালী আর শিব। ওরাই বাবা মা খগেনের। মাকে চিনত। বাবাকেও। কিন্তু বাবা চিনত না।
পোষা বেড়াল আছে খগেনের। মাঝে মাঝে খগেন ভাবে কে কাকে পুষেছে? সেই যেন পোষ্য। বেড়ালটা না।
“দাদা, আজ মায়ের কাজ। আসবেন তো?”
খগেনের মায়ের পাতানো বোন। অনেক ছোটো ছিল তার মায়ের থেকে। সে মারা গেছে। খুব ভুগছিল। খগেন যাবে। কেউ মারা গেলে যায় খগেন। চুপ করে বসে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না। কেউ চাইলে গীতাপাঠ করে দেয়। টাকা নেয় না। এ পাড়ায় ভালো পুরোহিত পাওয়া দায়। গোটা জীবন যাদের ফাঁকিতে কেটেছে তাদের ওপারের জীবনটা যাতে স্বস্তিতে কাটে তাই খুব যত্ন নিয়ে গীতাটা পড়ে খগেন। আর কেউ বোঝে না। সে বোঝে। আর বোঝে অন্তর্যামী।
মানুষের শরীরের মধ্যে কত তন্ত্র। অথচ জননতন্ত্রে শুদ্ধাশুদ্ধিতে ভাগাভাগি হয়ে আছে সমাজ। দুটো ডিম্বাশয়। একটা জরায়ু। একটা যোনি। স্তন। কী কীভাবে ব্যবহার করেছে মানুষ একে সমাজে। ইতিহাস সাক্ষী। মাংস, রক্ত, ঘাম। গোটা সংসারের ভিত্তি। অথচ কত ছলচাতুরীতে বিকিয়ে যাচ্ছে দিনরাত। তার নিজের জননতন্ত্রে মারণরোগ। প্রস্টেট ক্যান্সার। বেশিদিন নেই হাতে খগেনের। যেদিন থেকে জেনেছে সেদিন থেকে রোদ আর অন্ধকার দুই-ই ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। এ পাড়ায় মানুষ আসে জননতন্ত্রের খরিদ্দার হয়ে। জন্ম দিয়ে যায় জারজ সন্তানদের। খগেনদের। সবাই তো মাষ্টার হয় না। খগেন বিএ পাস। তার নাম তার দাদুর নাম নাকি। মা জেদ করে রেখেছিল। খগেন বসে আছে তার মায়ের পাতানো বোনের শ্রাদ্ধে। মানুষের মধ্যে কী যেন একটা আছে। কানা উঁচু থালার মত। অভিমান।
মা গলায় দড়ি দিয়েছিল খগেনের। এ ঘরেই।
======
প্রতিদিন অল্প অল্প করে মারা যাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খগেন। কেমো নেয় না। মা কালীর প্রসাদী ফুল তলপেটে বুলায়। সুকান্তের হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে বিন্দু বিন্দু মালার মত গেঁথে রাখে। জানে শেষকালে হারিয়ে যাবে। মা কালীকে দিয়ে যায় তাই প্রতিদিনের মালা। মায়ের পায়ে। মায়ের সব মনে থাকে।
রাত দুটো। খগেনের প্রচণ্ড জ্বর। এ জ্বর ছাড়বে না খগেন জানে। ঘরের ভিতর চারদিকে আরশোলা। মাঝে মাঝে গায়ে, হাতে বসে থাকছে। মেঝেতে শুয়ে আছে খগেন। মাদুরের উপর উপুড় হয়ে। মাদুরে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়ছে পুরুষাঙ্গ চুঁইয়ে চুঁইয়ে। খগেন জীবনের অবশিষ্ট ফুলের মালাগুলো গাঁথছে। মা কালী বসে আছেন সামনে। খগেনের দিকে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে।
দরজায় ধাক্কা। দাদা… .দাদা…..
বিলু এসেছে। বিলু পুরুষ না। আবার নারীও না। বিলুর শরীরকেও চায় এখানে এমন মানুষও আসে এখানে। বিলু ভালোবাসে ভীষণ খগেনকে। বিলু খগেনের কাছে গীতা পড়তে শিখেছে। গীতা মুখস্থ বিলুর। সে বলে এ জীর্ণ শরীরের উপর দিয়েই যা যাওয়ার যায় দাদা, আত্মা চিরকালের শুদ্ধ। বিলুর অদ্ভুত সব অনুভব হয়। দর্শন হয়। একদিন নাকি সুদামাকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন এ খারাপ পাড়ায়। বিলুর বাড়ি কলাইয়ের ডাল আর বাঁধাকপি খেয়েছিলেন ভাতে মেখে। আর বিলুকে দিয়ে গেছেন এক অদ্ভুত শাঁখ। যার শব্দ হয় না। আলো বেরোয় ফুঁ দিলেই। নীল আলো বেরোয়। বিলুর সে শাঁখে ফুঁ দিতে এমন কান্না উপচিয়ে এলো….সেদিন সারাটা ঘর কোটিসূর্যের আলোয় ভরে গেল। কৃষ্ণ বললেন, বিলু এই তোমার বিশ্বরূপ দর্শন হল। বিলু বলে দাদা কেউ শুদ্ধ অশুদ্ধ হয় না গো। হয় শুধু মন। মনের গভীরে ডুবে দেখো দাদা অন্ধকার পেরিয়ে একটা কাদা নালা আছে। সে নালা দিয়ে মাথা নীচু করে বেরোলেই আলোর মাঠ। সে মাঠে একটা কদম গাছ। পাশে যমুনা। আমার শ্রীরাধারাণী আসছেন দেখো, ওই যে নূপুর বাজছে দাদা….শুনছ….ওই যে তিনি আসছেন….আমার গোবিন্দের কাছে আসছেন….দাদা…..
খগেনের মাথার কাছে বসে বিলু কী সব বলে যায়। খগেনের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বিলু জল দেয়। কাঁদে। দাদা তুমি চলে গেলে…..
খগেন বিলুর হাতটা ধরে। বলে, ভাই.. আমার মাকে আর বাবাকে আমার নাভির সঙ্গে জলে ভাসিয়ে দিবি….ওই যে ওরা…...
মাথার কাছে পটদুটো দেখায় খগেন।
বিলু নিজের মাথাটা খগেনের বুকের উপর চেপে দিয়ে দুটো হাত মেঝেতে মারতে মারতে বলে…সব করবে দাদা…তোমার এ বিলু সব করবে….তোমার মুখাগ্নি থেকে তোমার পিণ্ডদান সব করবে…..তুমি উত্তম লোকে যাবে দাদা…..তোমার মত মানুষের অধোগতি হয় না দাদা……
খগেনের জ্ঞান হারায়। বিলু মাথার কাছে বসে থাকে। ঘরে উদাসীন স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো এসে জিজ্ঞাসা করে, ও কী গেল?
পোষ্য বেড়ালটা জানলা ডিঙিয়ে চলে যায়। মিশে যায় অন্ধকারে।
=======
পরেরদিন সকালে চায়ের দোকানে আবার ধোঁয়া ওড়ে নতুন আঁচের। সকালের বন্দনা করতে করতে ধোঁয়া স্বর্গের দিকে যায়। পরেশ এসে বসে তার গদিতে। জনার্দন সাইকেলটা স্ট্যাণ্ড করে দোকানে ঢোকার আগে একবার আড়চোখে তাকায়, বুকটা ফাঁকা লাগে। পরেশ উদাস চোখে তাকায়। বিমলের মা কাঁচের গ্লাসগুলো ধুতে ধুতে আঁচলের খুঁটে চোখটা মুছে বলে….মানুষটা কদ্দিন ধরে আসত….একটা আত্মীয়তা……
জনার্দনের মন্ত্র আটকায়। গলা ধরে আসে। আবার খাঁকারি দিয়ে মন্ত্র পড়া শুরু করে। পরেশ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খগেনের মুখে কী একটা যেন আলো ছিল। পরেশের ঈর্ষা হয়। বলে, ওদের কাজের জন্য কিছু টাকা পাঠাবা নাকি বিমলের মা?
বিমলের মা সাড়া দেয় না। সে পুকুরপাড়ে বসে বাসন মাজছে। আজকের দিনটা যেন ভীষণ শুদ্ধ। কেন বুঝে পায় না।