Skip to main content

 

গুড় বেচি.... আর কীর্তন গাই.... আজকাল কীর্তনে টাকা নাই....

গুড় কেমন?

এ ক্লাস....লাগবে?

লাগবে....ভালো হলেই টাকা দেব....বাড়ির সবার সুগার....যা তা খাওয়াবা না...

একদম এ ক্লাস....ফাসক্লাস গুড়....খেয়ে দেখবেন.....

অগ্রহায়ণের ঠাণ্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ায় চুল উড়ছে কীর্তনীয়ার। তার যে হবু খদ্দের, সরকারি কর্মচারী, খবরের কাগজে মুখ গুঁজে। ভটভটি প্রায় মাঝ গঙ্গায়। শান্ত গঙ্গা।

কীর্তনীয়া আড়চোখে দেখল তার হবু খদ্দেরকে। মাফলারের রঙটা বেশ। মোটাও। ভালোই ঠাণ্ডা মানাবে। মাফলারটা দেখে শীতটা যেন বেশি লাগল। কালো চাদরটা গায়ের সঙ্গে আরো জড়িয়ে বসল। ভটভটিতে এই সময়ে বেশ ভিড়। সব কাজে যায়। ওপারে গিয়ে টোটো ধরে স্টেশান।

গুনগুন করে গাইছে কীর্তনীয়া। মাথুর। গঙ্গার জলে সরষে ফুলের মত রোদের টুকরো ভাসছে। সূর্যের তেজ নেই। আচমকা দুটো আওয়াজ করে ভটভটিটা থেমে গেল। সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল, কী হল, কী হল?

দাঁড়ান....দাঁড়ান....দেখছি.....

কেউ বলল, তেল নেই? কেউ বলল, পুরোনো মেশিন?... কেউ বলল, বৈঠা নেই?.....কেউ বলল, ট্রেন মিস হবে যে গো....আর কোনো দিকে কোনো নাও নেই?

কীর্তনীয়া কিছু বলল না। কী করবে, মাথুর তার গলা ছেড়েই যাচ্ছে না। তার হবু খদ্দের কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ওপারের দিকে তাকিয়ে....কপালে ঘাম। এ ঘাম তো ওই দামী মাফলার, জ্যাকেটের না গো।

একটু পর হইচই থামল। ভটভটি শান্ত গঙ্গায় ভেসে চলেছে নিজের মত। চালক আর দুজন হাল ছেড়ে ফোন করছে একে ওকে....নৌকা আন....নৌকা আন.....বাবুরা ওপারে যাবে যে....

বাবুরাও একে তাকে ফোন করছে...চিন্তার ফোন...উদ্ববেগের ফোন.....

কীর্তনীয়ার চাবি টেপা ফোন। কোমরে গোঁজা। থাক বোবা। মাথুর গলা, বুক মাথা ছেয়ে যাচ্ছে শ্রাবণের মেঘের মত। বুকের মধ্যে ঝড় উঠছে অনুরাগের। বাবু আপনাদের অনুরাগ নাই?

সবাই বসে আছে চুপ করে। আচমকা কীর্তনীয়া উঠে দাঁড়ালো নৌকার মাঝে। গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল....মাথুর না.....বিদ্যাপতি না....ভবা পাগলার গান….নদী ভরা ঢেউ বোঝ নাতো কেউ

কেন মায়ার তরী বাও বাও গো

ভরসা করি এ ভব কাণ্ডারী

অবেলার বেলা পানে চাও চাও রে ।।

নৌকা উঠল দুলে। বাবুরা তাকালো। কেউ বিস্মিত। কেউ বিরক্ত। কেউ উদাস। কেউ নির্বিকার।

কীর্তনীয়া দুই হাতে তালি দিয়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর গাইছে। নৌকা টলমল। কিন্তু ভয় নেই। কীর্তনীয়ার বাবার কথা মনে পড়ছে। এ গান বাবার কাছে শেখা। বাবা হাত ধরে নিয়ে যেত আখড়ায়। সেখানে সব মহাজনের বাস। মহাজনের পদ। মহাসুখ! বাবুরা, অনুরাগ নেই? বাবু অনুরাগের অঞ্জন মাখেন….কোনদিন মাঝ দরিয়ায় নাও আটকায় চরে….বাবু যাবেন কোয়ানে? অনুরাগের অঞ্জনে পার পাবেন….নইলে এ জগত চোরাবালি….

ঘোর লেগেছে ভটভটিতে। দূর থেকে আসছে উদ্ধারকারী নাও। কীর্তনীয়ার দুই চোখ ভাসছে জলে। কী আনন্দের স্রোত নেমেছে আজ প্রাণে।

উদ্ধারকারী নৌকায় ওপারে এলো সবাই। একে একে নামছে। চলায় তাড়া নেই। কীর্তনীয়ার লজ্জা লাগছে। কী বাড়াবাড়ি করে ফেলল সে! হবু খদ্দের তার দিকে আড়চোখে চেয়ে নেমে গেল। কীর্তনীয়া লজ্জা পেল।

পরের দিন সবাই এলো নৌকায়। কীর্তনীয়া এলো না। সবাই খুঁজল মনে মনে। তাকালো এদিক ওদিক। যখন নাও ছাড়ল, তবু সে এলো না। সবাই বলল, ভাগ্যিস এলো না….পাগল একটা…..তার হবু খদ্দের বলল, কথার দাম নেই কেন? গলায় অভিমান।