Skip to main content
 
 
লেখকঃ গুস্তাভ ফ্লবেয়ার
অনুবাদকঃ সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ/ নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়/ আফতাব হোসেন
 
       মাদাম বোভারি লেখা হচ্ছে ১৮৫৬ সালে। আনা ক্যারেনিনা ১৮৭৮ সালে। ঘরে বাইরে ১৯১৬ সালে। প্রথমটি লেখা হচ্ছে ফরাসী ভাষায়, লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার; দ্বিতীয়টি লেখা হচ্ছে রাশিয়ান ভাষায়, লেখক তলস্তয়; শেষেরটা বলাবাহুল্য, তবু বলি, ভাষা বাংলা, লেখক রবীন্দ্রনাথ।
       প্রতিটা উপন্যাসের মূলে সমাজ আর ব্যভিচারের গল্প। কেন্দ্রে একজন ব্যভিচারিণী। 'ব্যভিচার' শব্দটা আজকের কথিত ভাষায় বড্ড সেকেলে, কিন্তু আপাতত ভাব প্রকাশের অন্য কোনো ভাষা পাচ্ছি না। প্রথম দুটো উপন্যাসে আত্মহত্যা পরিণামে। রবীন্দ্রনাথ নায়িকাকে না মেরে ব্যভিচারিণীর স্বামীকেই মেরে ফেলেছেন। কিন্তু এই এম্মা (মাদাম বোভারি), আনা আর বিমলা'র মধ্যে কোথাও পার্থক্য তো আছেই। সেই অর্থে আনা'র সাথে যে মিল এম্মা', সেইখান থেকে বিমলা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। 'নষ্টনীড়' কিম্বা 'চোখের বালি'র নায়িকারাও অনেকটা অন্যরকম। আমি এই অন্যরকম শব্দের আড়ালে কি ঢাকতে চাইছি? কি বলতে চাইছি? অনেক বেশি সংযত? অনেক বেশি অস্পষ্ট নিজেদের চিন্তা-আবেগ-নৈতিক দ্বন্দ্বে? সে অস্পষ্টতা কতটা লেখকের সেই সময়ের প্রাচ্য সমাজ আর পাশ্চাত্য সমাজের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন তো থেকেই যায়। 'চোখের বালি' অত্যন্ত কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। কিন্তু বইটির উপরে আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি হয় না। মাদাম বোভারি'র উপর হয়।
 আমার আলোচনার কেন্দ্র যদিও 'মাদাম বোভারি' উপন্যাস, তবু বারবার পড়তে পড়তে আমার আনা'র কথা মনে এসেছে। যদিও আনা'র সাথে এম্মা'র চরিত্রগত পার্থক্য আছেই। আনার চরিত্রের বাঁধন এম্মা'র থেকে শক্ত। এক ভ্রুনস্কি ছাড়া আনা'র মনের গতির অন্যধারা দেখা যায়নি। এম্মার মনের গতি অন্য ধারায় গেছে একাধিকবার। আবেগে আনা আর এম্মা'র মধ্যে যদিও প্রবল মিল।
       এম্মা বিয়ের পর বুঝলেন, প্রেমের যে বাঁধনে তিনি বাঁধা পড়েছেন, তাতে প্রেমের চাইতে বাঁধনের উপস্থিতি অনেক বেশি। তার স্বামী চার্লস একজন সাধারণ মাপের পুরুষ। তার আবেগ, তার স্বপ্ন, তার কল্পনা বড্ড একঘেয়ে, খুবই সাধারণ মানের। এম্মা'র কল্পনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা অতি তীব্র, তীক্ষ্ণ, ঈর্ষাদংশিত। এম্মা তার স্বামীর নিশ্চিন্ততা ঘেরা জীবন, এম্মাকে পেয়ে সব পেয়েছির দেশে থাকার আত্মগর্বে দিনযাপন অসহ্য ঠেকতে লাগল। কেন কেন কেন? কেন কোনো উত্তেজনা নেই মানুষটার? কেন সে কবিতার সুক্ষ্ম আবেগে সাড়া দেয় না? কেন সৌন্দর্য, চিন্তা-বিলাসিতার রোমাঞ্চকর যৌবনমদপূর্ণ আবেদনে তার স্বামী এত শীতল, এত সাধারণ? কোথায় সে চির আকাঙ্ক্ষিত জীবন এম্মার? যে জীবন প্যারিসের সমৃদ্ধঘরের রুচিশীল মহিলারা যাপন করেন। থিয়েটার, নভেল, পার্টি, নাচ-গান-বাদ্য কই জীবনে? এই গ্রামেই কি পচে মরতে হবে সারাটা জীবন তাকে? অথচ কি নেই তার? তার সব চাইতে বড় সম্পদ তার রূপ, তার যৌবন। কোন অংশে কম সে? কেন সে ঝাঁপ দেবে না যৌবনের আমোদ উত্তেজনাপূর্ণ জীবনের উত্তাল সাগরে? কেন সে নিজেকে এভাবে তিলে তিলে ক্ষয় করবে একজন অপদার্থ, কুশ্রী, বোকাবোকা সাধারণ মানের চিকিৎসকের গৃহিণী হয়ে? এ তার ভবিতব্য হতে পারে না। কিছুতেই পারে না। তার সন্তানের উপর তার বিরক্তি লাগে, তার গ্রামের প্রতিটা মানুষ, দৃশ্য, ঘটনাবলী সবকিছুতে তার চূড়ান্ত বিবমিষা। কবে আসবে তার রাজপুত্তুর? কবে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সে, এনে দেবে তাকে তার স্বপ্নের জীবন, যার সে যোগ্য?
       এইভাবেই শুরু হয় এম্মা'র অতৃপ্তির, অসন্তোষের, উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রবল আলোড়নের গল্প। এক একজন পুরুষ আসে। এম্মা রয়ে যায় অতৃপ্ত। সে যা চায় সে তা পায় না। গল্প খাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে, নানা ঘূর্ণাবর্তে পাঠককে নিয়ে চলে, ক্রমে একটা আসন্ন খাদের দিকে গড়িয়ে যায়।
       উপন্যাসে বিজ্ঞান আর ধর্মের বিরোধের গল্প আছে। কুসংস্কার আর গ্রাম্য সঙ্কীর্ণতার গল্প আছে। লোভের গল্প, ঈর্ষার গল্প আছে। উদারতার গল্প আছে আবার সরলতার, মূর্খের স্বর্গের গল্পও আছে। বইটা সেই সময়ে নিষিদ্ধ করার চেষ্টাও হয়েছিল।
 
       লেখার ধারার বিশেষত্ব হচ্ছে সাংঘাতিক নিষ্ঠুর দরদী সাবলীলতা। লেখক যেন অনেকগুলো তুলি হাতে বসেছেন। এক একটা ঘটনা আর চরিত্রের জন্য তুলির চরিত্র বদলাচ্ছে, কিন্তু কখনওই টানের মধ্যে শিথিলতা আসছে না। রসিকতাতেও কম যান না তিনি, একটা দৃশ্যে যখন বাইরে উন্মুক্ত ময়দানে বিশাল সভায় নানা নীতির গুণগান ইত্যাদি হচ্ছে প্রকাশ্য জনসভায় তখনই সেই প্রাঙ্গণ সমীপে এক ত্রিতল গৃহে মাদাম বোভারি ওরফে এম্মা'র সাথে তার প্রেমিক রুদলফের প্রেমের দৃশ্য বর্ণনা হচ্ছে এক একটা প্যারাগ্রাফ অন্তর। একে রসিকতা ছাড়া কি বলবেন? পাঠককে যেন তিনি সেই বহুতল বাড়ির পাঁচিলে ঝুলিয়ে এক হাতে ঘরের ভিতরের গল্প আর আরেক হাতে সমাজের মুখোশের কারুকার্য দেখিয়ে যাচ্ছেন। দুইতেই আমোদের ব্যবস্থা করেছেন।
       সেদিনের গপ্পো থেকে আজকের বাংলা সিরিয়াল। আমার একটাই প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘোরে, গল্পটা এত জমে কেন? পরকীয়ার গল্প তো আছেই। সে গল্পে নারীকে বাইরে এনে সমাজের মন এত মজে কেন? সেকি কোথাও একটা তার পরিস্থিতির মধ্যে আমোদ পায়? যেন একটা বাঘকে হঠাৎ করে আধুনিকতম শহরের কেন্দ্রে এনে তাকে বিব্রত দেখে মজা পাওয়া? শিকারীর ছদ্মবেশে তাকে এনে তারপর তার শিকার হয়ে যাওয়ার যে গল্পগুলো এত জনপ্রিয় সেকি পরোক্ষভাবে কোথাও একটা নীতিমালার গল্প হয়ে ওঠে? অন্তত আমরা কি তাই খুঁজতে যাই? একি অবশেষে দেখ কেমন লাগেটাইপের গল্প? পুরুষের ব্যভিচারিতার ধার অনেক কম। তা দিয়ে থ্রিলার হয়, পরকীয়ার গপ্পো ঠিক জমে না। আমরা নারী চাই, একজন নারীকে ঘরের বাইরে আনো, তার দোষেই বাইরে আনো, তারপর কিছু পুরুষের প্রলোভনের গপ্পোও জুড়ে দাও। এইবার লাগ লাগ লাগ নারদ নারদ।
       আসলে এইবার থ্রিলার লেখা হোক। আর এইসব না। কিন্তু যারা বই পড়েন, এই ফেসবুক করেন, তারা তো বাংলা, হিন্দী সিরিয়ালও দেখেন বলুন? আর পরকীয়া ছাড়া কি বা গপ্পো হতে পারে? তবে বলি কি এবার গপ্পোর ধারাটা পাল্টাক। আমি সিরিয়াল তথা আগামী গল্পকারদেরকেই বলছি, এবার ব্যপারটা থ্রিলারের আঙ্গিকে হোক। কাউকে আর নাস্তানাবুদ করতে হবে না। এম্মা, আনা, বিমলা --- এরা পুরুষের ভালোবাসার বাইরে অন্য কোনো কাজ করুক। কাজ শিখুক। নিজের পরিচয় নিজের মত করে গড়ুক। স্বামীকে সিংহদুয়ার আর অমুককে খিড়কীদুয়ার করে বাঁচার গল্প, তারপর একদিন এ দুয়ারের সাথে ও দুয়ারের ঠোকাঠুকিতে আত্মদানের গল্পগুলো বন্ধ হোক। ব্যভিচার ছেড়ে থ্রিলার আসুক। থ্রিলারের থ্রিল না থাকলে জীবনের লড়াইয়ের গল্প আসুক। সেই যে গল্পটা 'সাধারণ মেয়ে' হিসাবে লিখতে বলা হয়েছিল শরৎবাবুকে, সেই গল্পটা লেখা হোক। শাশুড়ি বউ মিলে ন্যাশেনাল জিওগ্রাফি দেখুক, বেক্সিট নিয়ে গল্প করুক, সাথে গয়নাগাটি, শাড়ির গল্পও চলুক না, কিন্তু থ্রিলার লিখুন প্লিজ... আর পরকীয়া নয়...

 

Category