Skip to main content

রোগা ছিপছিপে শরীর। প্যান্ট আর জামা অতিব্যবহারের সীমারেখা পেরিয়ে গেছে। বয়েস দেখে মনে হবে সদ্য হয় তো পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মুখে শুনলাম, বয়েস তেষট্টি। "আমি এই তেষট্টি বছর এই মাঠে আসছি... এমন সাপ দেখিনি আগে।"

      হাতে গুলতি, পায়ের কাছে মাটি দিয়ে বানানো অনেকগুলো গুলি। সামনে বড় পুকুর। পুকুরে মাছ চাষ হয়। মানুষটার সারাদিনের কাজ গুলতি দিয়ে পাখি তাড়ানো। নইলে কি হবে?

      "এক-একটা পাখি যা মাছ খায় একমাসে এই এত বড় পুকুরের সব মাছ শেষ হয়ে যাবে।"

      সূর্যাস্ত হতে আরেকটু দেরি আছে। দূরে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে দেখা যাচ্ছে। এদিকটায় ঘরবাড়ি নেই। যতদূর চোখ যায় মাঠ আর মাঠ। এখন ক্ষেতে সরষে চাষ হচ্ছে। যতদূর চোখ যায় হলুদ আর হলুদ। মাঝে মাঝে বড় বড় পুকুর, সেইখানে মাছচাষ হচ্ছে। আর এই এমন খাঁ খাঁ করা ক্ষেতের মাঝে এদিক ওদিক একলা দাঁড়িয়ে টিনের ছাউনি দেওয়া একটা করে ঘর। এই মানুষগুলো থাকে। যারা সারাদিন পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে পাখি তাড়ায়। মালিকের মাছ বাঁচায়। ওইতেই পেট চলে যায়।

      চলে যায়?

      "ছেলেটা গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। যেতে দিইনি পুরো লকডাউন। মালিক ডাকল, আয় মাস্ক বানাবি। ছেলে বলল, বাবা যাই? আমি বললাম না, এইখান থেকে কলকাতায় কিসে যাবি? ট্রেন বন্ধ। সে বলল, যা হোক করে চলে যাব। থেকে যাব। আমি বললাম, না, বেঁচে থাকলে পয়সা এমনিই কামাবি। আমার দরকার নেই অত টাকার। এই চব্বিশ বছর বয়েস। আমাদের ওই এক ছেলে... আ রে রে রে রে রে... হুস্ হুস্ হুস্…"

      জলের উপর নিঃশব্দে ডানা বিছিয়ে পা ডুবিয়ে একটা পানকৌড়ি নামতে যাচ্ছিল। গুলতির বুকে টান পড়ল, মাটির গোলা গিয়ে পড়ল জলে --- ঝপাস! পানকৌড়ি উড়ে গেল।

      এখন যাচ্ছে কাজে?

      "এখন যাচ্ছে। এখন করোনা অনেকটা কম। আমাদের গ্রামে আমরা খুব লকডাউন মেনেছি... কেউ কারোর বাড়ি যাইনি... দোকানে মাল নিতে গেলেও দূরে দূরে…"

      এইতেই চলে যায় আপনাদের?

      "গরু দুটো ছিল। বেচে দিলাম। কিছুতেই যাবে না। মশার কামড় খেতে দিতাম না। খুব যত্ন করতাম। মশারির মধ্যে রাখতাম। কি চকচকে গা ছিল!"

      বেচে দিলেন?

      "বিচালির ভীষণ দাম। খেতে দেব কি?"

      লকডাউনে?

      "না না। গেল বছর থেকেই। ধান কম হল গেল বছর। তাই বিচালির দাম যা হল, কিনব কি করে? এ বছর আবার অনেক হয়েছে। দাম নেই। সে কিছুতেই যাবে না জানেন। তারপর আমার ছেলে এসে বলল, বাবা তুমি মাঠে যাও। তুমি থাকলে ও যাবে না। কি করুণ চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে আপনাকে কি বলব।"

      চোখ গলছে। সূর্যাস্তের নিরভিমানী রঙ তার বাইফোকাল চশমার নীচের অর্ধবৃত্তে একটা মিছিমিছি সূর্য এঁকেছে, হলুদ টকটকে। সেই রঙে চিকচিক করছে চোখের কোল। ভদ্র শিক্ষিত মানুষের সামনে গরুর জন্য কাঁদা যায়? কি বলবে, আদিখ্যেতা? শাসিত জল নামল না কোল বেয়ে।

      "ওই বাচ্চাটাকে আটকান। আপনাদের সঙ্গে এসেছে তো?"

      হ্যাঁ। আমাদের সঙ্গেই।

      "আপনারাও আর থাকবেন না। এদিকে সাপের উৎপাত খুব। বিষাক্ত সব সাপ। এই তো কয়েকমাস আগে, আমাদের গ্রামের ছেলে, পনেরো মিনিটও সময় দিল না। মাটির রঙের সঙ্গে মিশে থাকবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না... ওই যে ক্যামেরা কাঁধে উনি... দেখুন পায়ের দিকে তাকাচ্ছেন না…. হুস্ হুস্… আ রে রে রে রে রে রে রে…. হুস্….ওরে তাড়া তাড়া…."

      পুকুরের ওদিকে একটা অল্পবয়েসী ছেলে। একটা ভাঙা টিনের উপর বসে। খানিক আগেই এদিকে আসার সময় ওকে দেখে এসেছি। স্মার্টফোনে সিনেমা দেখছে। পাশে বসেছিল ওর পোষ্য কুকুরের বাচ্চা। আমাদের দেখেই পালালো। কালো একটা, হলুদ একটা। হলুদটা পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওর পায়ে লাগল কি করে?

      "এদিকে বাইক নিয়ে আসে না... মাঠের মধ্যে নেমে যায়... ও ধাক্কা খেয়ে গিয়েছিল"...

      সেই ছেলেটা গুলতি টিপ করল। পুকুরের ওদিকটা অনেক দূর। এদিকের মাটির গোলা পৌঁছাবে না। তাই বলা, "তুই তাড়া… তুই…"।

      দূরে কয়েকটা বড় বড় গাছের মাথার উপর বকের সারি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে, আবার বসছে এসে। কয়েক ঝাঁক মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল সার বেধে।

      রাতেও থাকেন?

      "না না। এই চলে যাব। রাতে সাপের ভয়। ওই যে খাঁচাটা দেখছেন…."

      টিনের ঘরের সামনে রাখা একটা কাঠের খাঁচা।

      "কয়েকটা মুরগী পুষেছিলাম। সব শেয়ালে নিয়ে গেল। রাতে শেয়ালের বড় উৎপাত। সাপ তো আছেই। আপনারা এইবার ফিরে যান, অন্ধকার হয়ে গেলে সাপের গায়ে পা পড়লে…"

      ওনার পায়ে নীল হাওয়াই চটি। পিছন দিক আর বুড়ো আঙুলের দিক ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাটি ছুঁয়েছে প্রায়। এমন খোলা পায়ে হাঁটেন, গামবুট পরেন না? প্লাস্টিকের পাওয়া যায় তো….

      "বর্ষায় দেবে যায়। হাঁটাই যায় না। এখন শীত তাই মাটি এত খটখটে... বর্ষায় এই এতটা আসতে যা শ্রম... ওই যে দেখুন…

      পুকুরের গায়ে সাপের খোলস... হাওয়ায় উড়ব উড়ব করছে... মাটির চাপে আটকে….

"আপনারা ফিরুন এবার…."

আমরা ফিরছি। দূরে আজান শুরু হল। বাইকগুলো অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুরু হল শেয়ালের ডাক।

মাঠ, ধানক্ষেত, বিন্দু বিন্দু তারা ওঠা আকাশ পিছিয়ে যাচ্ছে। ওনারা ঘরে ঢুকে যাবেন। শীতের চামড়া ভেদ করা তীক্ষ্ম হাওয়া ওই ছেঁড়া ছেঁড়া হাতে বোনা সোয়েটারে মানায়? কে জানে তোমার ও সোয়েটারের সঙ্গে কার হাতের ছোঁয়া মিশে।

শহরের চায়ের দোকান। চারদিকে জমজমাট। আকাশ আড়াল করা হলুদ স্ট্রিট লাইটের আলো। শহুরে নেটিজেন মাফিক আলোচনা, সব চলছে। দু'একটা কুকুর মাথা নীচু করে, লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে তাকাচ্ছে। শহুরে কুকুরেরা মানুষ দেখলে পালায় না। ওরাও বাঁচার কৌশল বোঝে। ওই ল্যাংড়া বাচ্চা কুকুরটা অতবড় দিগন্তখোলা মাঠে দৌড়ে দৌড়ে দূরে থাকার অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে। ব্যথায় না আত্মভিমানে কে জানে?

এত এত দরকারি কথার মধ্যে আমার মাথায় দপদপ করে যাচ্ছে তেষট্টি বছরের দুটো চোখ, যা পুকুরের জলে নামা পাখির জন্য সজাগ থাকতে থাকতেও, একটা অবলা পশুর জন্য ব্যথায় চিকচিক করে ওঠে….. তেষট্টি বছরেও চোখে এত জল পাও!... আমাদের চোখ ভীষণ শুষ্ক…. পলিউশানে? কে জানে?