Skip to main content

 

333.jpg

বাঙালি ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের ব্যাখ্যায় মা কালী বহুবার চর্চিত হয়েছেন। মা কালীর স্তন, নগ্নতা, বীভৎসতা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রেক্ষাপট থেকে আলোচনা হয়েছে। কথামৃততেও আছে, ডাক্তার বলছেন কালী তো একজন সাঁওতালি মাগী। ঠাকুর হাসছেন।

গতকাল ‘এই সময়’ কাগজেও এক পাতা জুড়ে মা কালীর নাকে মাছি বসিয়ে কী সব দুর্গন্ধ, ঘাম, শ্রমজীবী ইত্যাদির সঙ্গে আগমবাগীশ, তন্ত্র ইত্যাদি মিলিয়ে ইয়াব্বড় একটা লেখা হল দেখলাম। ছবিটা যদিও ভালো লাগল না। কিন্তু এ ভাবে দেবদেবী নিয়ে বিকৃতভাবে ছবি তো আমাদের আজকে বলে না, আগেও আঁকা হয়েছে। সাধারণত এগুলো নিয়ে খুব একটা কেউ মাথা ঘামায় না। ঠিক যেমন প্রতিবেশী দেশে হিন্দুদের সঙ্গে কী হচ্ছে সে নিয়েও এদিকের লোকজন অত ঘামান না। সেই জন্যেই সেই নন-ইন্টেলেকচ্যুয়াল সংক্রান্ত ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার সংলাপটা আমার খুব ভালো লাগে। আসলেই এই সব নন-ইন্টেলেকচ্যুয়াল ইস্যু নিয়ে কথা বলতে আমরা বাঙালিরা ভালোবাসি না। মানে ভদ্রলোক শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন বাঙালিদের কথা বলছি।

কিন্তু মা কালীর এই শাস্ত্রীয় অ্যান্থ্রোপলজিকাল ব্যাখ্যা ছাড়া ইন্টেলেকট এটা বুঝে পায় না, এত বীভৎস রসের দেবী কী করে নন-ইন্টেলেকচ্যুয়াল বাঙালির মা হয়ে গেলেন। বাঙালি আর যা হোক, মারকুটে, দাপুটে বলে তো পরিচিত নয়। হিংসুটে, ঝগড়ুটে, তর্কুটে, মায় কুচুটে বলেও নিন্দুকেরা বলে। কিন্তু প্রশংসকেরা শান্ত, ভদ্র, ইন্টেলেকচুয়াল, সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ হিসাবেই দেখে। কিন্তু এমন একটা জাতের মা কী করে হয়ে গেলেন কালী। যিনি নগ্না। যিনি মুণ্ডমালা গলায়। খাঁড়া হাতে। ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা কোমল মাতৃরূপ তো নয় মোটেই। বাংলায় কী করে দেবীপুজোর প্রাধান্য হল, বৌদ্ধযুগের পরে পরে তন্ত্র কীভাবে বাংলায় ছড়িয়ে ছিল, কী ভাবে সে সব আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হল, এ সব আছে। কিন্তু বাংলার সেন্টিমেন্টে “মা” ডাকের জায়গা কী করে তৈরি হল, সেটা কি ইন্টেলেক্ট জানতে পারে? তারাদেবী তো বৌদ্ধমতের থেকে। কই বৌদ্ধদের জগতে তো কোনো কমলাকান্ত, রামপ্রসাদ, প্রেমিক জন্মালো না। কেন? মাতৃভাবের এমন কোমল, ঘরের ডাক তো মা মেরীও শুনলেন না। কেন তবে কালী শুনলেন? কেন মা জগদ্ধাত্রী, মা লক্ষ্মী, মা দুর্গা যিনি নাকি বাঙালির সব চাইতে বড় উৎসবের কেন্দ্র বিন্দু, তিনিও সে ডাকের কাছাকাছি এলেন না, যা মা কালী এলেন। কেন?

এর উত্তর নেই। তর্ক আছে অনেক। কিন্তু উত্তর নেই। আগমনীতে দুর্গা ঘরের মেয়ে হলেন। কিন্তু মা কালী আদতে মা'ই হলেন। কী করে?

একবার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নাটমন্দিরে বসে আছি। সন্ধ্যার সময়। গান হচ্ছে। শনিবার। বেশ ভিড়। একজন গাইছেন “মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মা'কে মনে পড়ে আমার মা'কে মনে পড়ে।”

একজন ভদ্রলোক, বয়স্ক, সস্ত্রীক বসে আছেন। গানটা হতে হতে দেখলাম, সেই ভদ্রলোক নাটমন্দিরের থামে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। পাশে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। অদূরে গঙ্গা। দক্ষিণেশ্বেরের মন্দিরের মাথায় আধখানা চাঁদ। সামনে ভবতারিণী দাঁড়িয়ে। পুজো চলছে। কিন্তু এ গান তো শ্যামাসংগীত নয়। তবে? এত অনায়াসে এ গান কী করে গাওয়া হচ্ছে এখানে? এর উত্তর বুদ্ধি জানে না। হৃদয় জানে। কিন্তু হৃদয়কে জানি - এ কথা কোন পাগলে বলবে?

কদিন আগে দুর্গাপুজো গেল। কাঁচরাপাড়ায় ভিড় থিকথিকে বাজার দিয়ে হেঁটেছি, নিয়মমাফিক সেই বাঁধাধরা গান বেজে যাচ্ছে কিশোর, মান্না, আরো আরো সব। কানে আসছে, প্রাণে তেমন কিছু সাড়া নেই। বরং শব্দের উৎপাতই লাগছে। কিন্তু দুদিন আগে সেই বাজার দিয়েই হাঁটছি। সেই ভিড়। কোনো এক বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাঝে মাঝেই শ্যামাসংগীত চালাচ্ছে। আমি খেয়াল করলাম যে দোকানি ফাঁকা বসে আছে, যে টোটোওয়ালা একা বসে আছে, যে মানুষ একা হাঁটছে, তাদের কারুর কারুর ঠোঁটের চলনে গানের অনুপ্রাস। অবশ্যই সবাই কোরাসে গাইছেন না। কিন্তু কোথাও যে একটা সাড়া জাগছে এ ভাবটা স্পষ্ট। কালীপুজোয় চাঁদার জুলুম, বাজির উৎপাত, নেশাভাঙের উৎপাত - সব আছে। আবার মা ডাকের একটা আনন্দও আছে। কী করে হল এটা? কালী কলকত্তেয়ালী হল কী করে? ভারতের এখানে সেখানে বাঙালিকে ঘিরে কালীবাড়ি, বাঙালির পরিচিতি তৈরি করল কী করে? বৈষ্ণবের কীর্তন। ব্রাহ্মের ব্রহ্ম। সব ছিলেন। আছেন। কিছু আবার নেইও। কিন্তু এই “মা” ডাকটা কি গোটাটাই শাস্ত্রীয়? তা তো নয়। বাঙালি দুর্বল বলে “মা মা” করে না। বাঙালি তো মা'কে আনন্দময়ী, চৈতন্যময়ী বলে ডেকেছে।

তবে? আবারও বলছি, বাইরে থেকে এ পুজোর দৈবী-অ্যান্থ্রোপলিজকাল ব্যাখ্যা, তর্ক অনেক আছে। কিন্তু প্রাণের ডাকের কাছাকাছি কী করে এলো, সে জানা যায় না। প্রাজ্ঞ মানুষেরা বলেন জ্ঞানহীন অবস্থা ভ্রান্ত জ্ঞানের থেকে অনেক ভালো। তাই “জানি না” শব্দটা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়।

হতে পারে আমি এই সেন্টিমেন্টের অংশী নই। হতে পারে আমি এ সবকে বাইরে থেকে জানি। তথ্যগতভাবে জানি। পরিংসখ্যানগত ভাবে বুঝি। কিন্তু চট করে একটা বিকৃত ছবি আঁকার আগে যেন এইটুকু ভাবি, এই সংস্কৃতিটা একটা বৃহদাংশ মানুষের নির্দোষ অনুভবের সঙ্গে জড়িয়ে। অন্যের উদারতা যেন আমার সংযমের কারণ হয়, স্বেচ্ছাচারিতার না। এইটুকুই বলার। আর শৈল্পিক স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্য যদি এইটুকু ক্ষেত্রই অবশিষ্ট থেকে থাকে, তবে বলব, ভালো, কিন্তু আরেকটু সংবেদনশীল হলে আরো ভালো। নইলে কাজটা সমীচীন হয় না। একরোখা হয়ে যায়।

(ছবিটা হালিশহর রামপ্রসাদ ভিটের প্রসাদময়ী মায়ের ছবি। ওঁদের পেজ থেকে প্রাপ্ত।)