Skip to main content

L1

 

নেটফ্লিক্সের সিরিজ, লিডিয়া পোয়েট। বাস্তবিক এমন একজন মানুষ ছিলেন ইটালিতে। জন্ম ১৮৫৫ সালে, মৃত্যু ১৯৪৯ সালে। দোষের মধ্যে তিনি আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন। বাড়ির অমত, সমাজের অমত, মায় আইনজ্ঞ পুরুষদের অমত, বিদ্বেষ সরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আজীবন লড়াই করেছিলেন মেয়েদের অধিকার নিয়ে এ কথা উইকিপিডিয়া জানায়।

কিন্তু নেটফ্লিক্স লড়াইয়ের গল্পের থেকে বলতে চায় লিডিয়ার অদম্য সাহসের গল্প। ঐতিহাসিক লড়াইকে গৌণ রেখে লিডিয়ার চরিত্র নির্মাণের দিকে সিরিজের আগ্রহ বেশি। প্রতিটা এপিসোডে এক একটা থ্রিলার এপিসোড। তার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদিও আছে। কিন্তু মোদ্দা কথা লিডিয়ার সাহস আর জেদের গল্প। আত্মাভিমানের গল্প।

লিডিয়ার চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন মাটিল্ডা, অসামান্য। তার অভিনয়ের রকম দেখতে গিয়ে আমাদের সেই সুচিত্রা-সুপ্রিয়া যুগের অভিনেত্রীদের মনে পড়ে যাচ্ছিল। কোথায় যেন অভিনয়ের ভঙ্গীতে ভীষণ মিল। কোথায় মিল? তাকানোতে? হাসিতে? খুব স্পষ্ট করে বলা যায় না। তবে মিল যেন আছে কোথাও একটা।

লিডিয়াকে নিমরাজি হয়েও সাহায্য করেছিল তার দাদা, আইনজীবী, এনরিকো। সাধারণত যারা দুর্বল, আইনের প্যাঁচে পড়ে অকারণ সাজা কাটছে তাদের সাহায্য করার গল্প নিয়েই সাজানো। তার মধ্যে আবার অ্যানার্কিস্টদের গল্পও আছে। অল্প আছে। বোন এক একটা কেস হাতে নিচ্ছে (দাদার অমতেই), দাদাকে বুদ্ধি দিচ্ছে, দাদা বোনের ইনভেস্টিগেশান অনুযায়ী কেস লড়ছে। দারুণ দারুণ সব ক্ল্যাইম্যাক্স আছে। মাঝে মাঝে মনে হবে খুব সরল। সে হোক। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন বাস্তব চরিত্রকে আর কতটা অ্যাডভেঞ্চারাস বানানো যায়। কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে কোথাও তো একটা বোঝাপড়া থাকা উচিত নাকি!

একটা সময়ে যখন লিডিয়ার হয়ে বিশ্বের অনেক তাবড়-তাবড় মানুষ বলছেন, আবার পুনর্বিচারের আবেদন জমা পড়েছে, মহিলা হয়ে আইনজ্ঞ হওয়া যায় কিনা এই নিয়ে, তখন অনেকে প্রার্থনা করছে লিডিয়ার জন্য যেন ঈশ্বর লিডিয়ার সহায় হন…. তখন লিডিয়ার বৌদি একটা দারুণ কথা বলল, "যা কমোন সেন্স দিয়েই হয়ে যায়, তার জন্য মেয়েদের বেলায় ঈশ্বরের করুণার দরকার কেন পড়ে কে জানে!"

দারুণ কথা। সোজা কথা, কিন্তু গভীর কথা। একবার এক বিতর্কসভায় জাভেদ আখতার মশায় বলেছিলেন, এক সময় যখন বেশিরভাগ কাজে পেশীর দরকার লাগত, সেখানে মেয়েদের থেকে পুরুষ এগিয়েছিল বলে সমাজে পুরুষদের দাপট বেশি। কিন্তু এখন যখন সব মেশিনেই হয়ে যাচ্ছে তখন আর পুরুষ নারী কি!

কিন্তু কথাটা এতটাও তো সোজা নয়। মেয়েদের বুদ্ধিমত্তা নিয়েও তো প্রশ্ন আছে সমাজের। পারবে কি? মেয়েদের মেয়েলিপনা, যা নিয়ে নাকি এক পৃথক মনোবিজ্ঞান লেখা যায়, তারা পারবে? তাদের হাজার একটা লিমিটেশন, শারীরিক, মানসিক, অধ্যাত্মিক - এ সব তো নির্বিচারে স্বীকার করেই এসেছি আমরা, সেই তারা কি পারবে? তারা অকারণে কাঁদে, নেতিয়ে পড়ে, কোন্দল করে, তার উপর সুযোগ বুঝে শারীরিক অ্যাডভ্যান্টেজ নেয় না? যখন তখন মোহিনীরূপ ধারণ করে পুরুষদের শুভবুদ্ধি, সাংগঠনিক বুদ্ধি গুলিয়ে দিয়ে একাকার করে না? এ সব নিয়ে আমাদের মেলা সংশয়। উইকিপিডিয়াতে পড়লাম, এখনও নাকি ইটালিতে মহিলা উকিলদের "ওহে মিস / মিসেস" বলে ডাকা হয়, যেখানে পুরুষ উকিলদের "ওহে উকিলবাবু" বলে ডাকা হয়। ইটালি না হয় যাক, এখনও তো আমাদের সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিনোদনের জগত হয়ে সোশ্যালমিডিয়ায় সব "দুষ্টু" খবর, মুখরোচক খবরই তো ওই কয়েকটা অঙ্গ ঘিরে। কতটা দেখালো আর কতটা ঢাকল, এই নিয়ে খবরের পর খবর, আলোচনার পর আলোচনা। ওদিকে আইনের ফাঁক দিয়ে একের পর এক মানুষ বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে, সে হাথরাসই হোক কি বিলকিস। আর কিছু দূর গেলে ইরানে আফগানিস্তানে? আহা আহা, তওবা তওবা… কি আইন চলছে….। মেয়েরা যাতে স্কুলে যেতে না পারে বিষ খাইয়ে অসুস্থ করে দেওয়া হচ্ছে। বাহ রে বাবা। গোটা বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আরেকবার ইরান-আফগানিস্থানের মেয়েদের চূড়ান্ত হেনস্থার খবর পড়ে যাচ্ছে। আরে ভাই আমরা না হয় চুনোপুঁটি মানুষ, ফেসবুকে কপচে, কি কটা সভায় সাজুগুজু করে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ক'টা গরমাগরম সুক্ষ্ম তত্ত্ব আওড়ে চলে আসতেই পারি.. কিন্তু তোরা ভাই বড়সড় ইউনাইটেড নেশান না তো কি আরো সব কি তৈরি করে বসে আছিস। তা এমন কি আইন আছে রে তোদের যে এত এত অমানুষী ঘটনায় চুপ করে বসে থাকিস? তোরা বলবি কূটনীতি, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনীতি এইসবের কথা…. দেখ বাবারা আমার, এ সব কথা আমাদের ভীষ্ম থেকে মায় ধর্মমূর্তি যুধিষ্ঠির অবধি জানত। অর্জুন, ভীম অবধি জানত। কিন্তু কি হল রে? সেই তাদের আইনের হাজার একটা কূটকৌশল নীতিতে আটকে দুর্যোধন আর দু:শাসনের গালে দুটো চড় কষাতে পারেনি উঠে। কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে বার করে দিতে পারেনি। তারাও তোদের মত বসে বসে দেখেছে। এমনই তাদের নীতিবোধ। নুড়ো জ্বেলে দিই অমন নীতিজ্ঞানে!

শোন ভাই, যদি সত্যিই নিজেকে আন্তর্জাতিক, কসমোপলিটান ভেবে থাকিস, তবে আফগানিস্তান আর ইরানের বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেল। নইলে হোটেলে ঢুকে খাবার মেনুতে, "টুওওওর" করতে গেলে ইউরোপের দেশের লিস্টিতে, কি বই-সিনেমার নাম উচ্চারণের সময় গোটা বিশ্বকে বাড়ির উঠানে দেখিস, এ ভাব করিস না বাপু! কদিন আগে মেলা মেলা গাইনির সামনে কি বলা হল? গর্ভবতী মায়েদের রামায়ণ মহাভারত পড়াও। ওতে জিনের গঠন চেঞ্জ হবে। মায় ক্যাসেট সিডিও পাওয়া যায় বাজারে দেখেছি, গর্ভবতী অবস্থায় শোনার জন্য। আরো কি বলা হল, মায় অতগুলো ডাক্তারদের সামনে বলা হল, যে সমস্ত বাবা মায়েরা একটা পুরুষসন্তানের পর একটা মেয়ে সন্তান চায়, তাদের বাচ্চাই নাকি পেটে থাকতে থাকতে জিন উল্টেপাল্টে এলজিবিটিকিউ গোত্রের হয়ে পড়ে। বাবা গো বাবা! বলি হ্যাঁ গা, একজন ডাক্তারও উঠে চিল্লিয়ে বলল না, এ সব বলা মানে আমাদের শিক্ষাদীক্ষাকে অপমান... এসব শোনা মানেও আমাদের নিজেদেরকে অপমান! নাহ, কেউ বলল না। সবাই শুনল। কজন ডাক্তার আবার সহমতও হল। খবরের কাগজে বড় করে ছাপা হল, এই দুদিন আগে। কেউ কিচ্ছুটা লিখল না। বিহারে মহিলাদের বিনা অ্যানেস্থেশিয়া স্বেচ্ছা বন্ধ্যাত্বকরণ করে দেওয়া হল। চীৎকারে কুকুরবেড়ালের চোখে জল এলো। তারপর সব শান্ত। একটা ছোট্টো তদন্ত হল। আরো অনেক অনেক আছে। সব লিখলে তো.... যাক গে। সে সব সভাজীবী, বিতর্কজীবীদের জন্য নয়। সে সব ধুলোজীবীদের জন্য। তারা কই?

তার চাইতে এই সব ওয়েবসিরিজ দেখা যাক, ফেসবুক, ইনস্টাতে কিছু মনোরম পোস্ট করা যাক…. ব্যস…. হাই তুলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়া যাক…. বেড়াতে যাব… না ভালোমন্দ খাবো…. বই ছাপাবো… না বক্তৃতা দেব…. কি যেন একটা গোলমাল হচ্ছে…. হোক হোক। গোটা জগতই গোলমেলে, সেইসব সামলাতে গিয়ে নিজের জীবনের পরমায়ু খচ্চা করে কি লাভ! বালাই ষাট!... তার চাইতে গলা উঁচু করে বল… জয় নারী মাইকি.. নারী শক্তিকি… জয়! ব্যস।

L2