Skip to main content
 
 
 
মনের মধ্যে একটা নিরিবিলি ছাদ থাকে। একটা চিলেকোঠা থাকে। একটা বই সেখানে যতটা জীবন্ত একটা মানুষ ততটা নাও হতে পারে। সে চিলেকোঠা ততটা নির্জনতা, নিঃশব্দতা নয়, যতটা নিরিবিলি বা অবকাশ যাপনের তাগিদ। লেখক আর পাঠক মুখোমুখি বসে সেখানে। দু'জনেই একা। দু'জনের মত করে একা। একজন তার চেতনার সবটুকু নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে কিছুটা জীবন সংগ্রহ করেছেন নিজের মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে তাকে আপন মনের মাধুরী, ধী, পর্যবেক্ষণশৈলী সহযোগে একটার পর একটা শব্দ সাজিয়ে রচনা করেছেন --- যা তার নিজের সত্তা। 'ওয়ার এণ্ড পিস' যতটা নেপোলিয়ানের গল্প, ইতিহাসের একটা সময়ের গল্প, ততটা টলস্টয়ের মনোজগতেরও অংশ। ঐতিহাসিকের নেপোলিয়ান আর টলস্টয়ের নেপোলিয়ানে কোথাও তাই পার্থক্য থেকেই যায়। কোথাও হয়ত বা টলস্টয়ের অন্তর্দৃষ্টি ইতিহাসের দেশ-কালের সীমারেখা ছাপিয়ে এমন কোনো সত্যের নিকট পৌঁছে যায়, যা তথ্যে ধরা না গেলেও অনুভবে ধরা যায়? হতেও তো পারে? মানুষ তো শুধু একটা জীবনপঞ্জী না, তার থেকেও বেশি কিছু। তার আয়ুষ্কাল না হয় দেশ-কালের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ, কিন্তু তার চিত্তটা তো নয়! যদি তাই হত তাহলে কালিদাসের কাব্য, সুপ্রাচীন তামিল প্রেমের কবিতাগুচ্ছের কথা আমার কথা হয়ে ওঠে কি করে? কারণ চিত্ত অমর। চিত্তের ঢেউগুলোর আন্দোলন বাতাসে বাতাসে ভেসে ফেরে আরেকটা সংবেদনশীল চিত্তের খোঁজে। তাই কোনো এক ঐতিহাসিক চরিত্রের কান্না শরদিন্দুর মননলোকে আলোকিত হয়ে আমার চোখের কোল ভিজিয়ে যায়। সে দায় ঐতিহাসিকের তো নয়। ঐতিহাসিকের দায় তথ্যের কাছে নিজের জবাবদিহিতে নির্ভুল থাকায়। সেখানে সে সফল হলে তার পারিশ্রমিক হাতে ফুল্ল মনে বিদায় নেয়। কিন্তু সাহিত্যিকের দায় তো তার হৃদয়ের কাছে, সে সেই দায়ের কাছে নতিস্বীকার করে কালের গভীরে ডুব দেয়। তার নিজের চিত্তে চিরকালীন মানবচিত্তের হাসি-কান্না, আশা-হতাশা, উচ্ছ্বাস-বেদনার স্পর্শ পায়। তা তুলে নিয়ে আসে বর্তমানের পাঠকের কাছে। নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে অন্যের তৃষ্ণার জল সঞ্চয় করে রাখে।
        চিত্তের এই গভীর গহনে ডুব দিতে গেলে পাঠক আর লেখক উভয়েরই একটা নিরবিচ্ছিন্ন নিরিবিলির দরকার। নইলে ফাঁকি এসে জমে বিস্তর। কেবলই বাইরের কথার ধারাবিবরণে, স্নায়বিক উত্তেজনায় উজিয়ে পাঠককে বিহ্বল করে তোলা কোনো সৎ সাহিত্যিকের কাজ কি? সে তো খানিক চটুল সাংবাদিকতা আর ছদ্ম-সাহিত্যের সংমিশ্রণ। সে ফাঁকিতে কোনো লেখা যত না ঋদ্ধ করে তার থেকে চঞ্চল করে তোলে অনেক বেশি। চমৎকৃত করে ভাষার চপল ব্যবহারে। নিজের বোধের, অনুভবের নিঃস্বতা ঢাকতে বাইরের আবরণ আর আভরণের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে প্রবল করে। শ্রদ্ধেয় নীরদবাবু বলতেন ভালো বইয়ের মলাটের কোনো চাকচিক্য হয় না। সে সরল সহজ। এই কথাটা শুনে আমার বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলীর কথা মনে আসত। 
        আসলে সুলেখকের হদিশ দেন সুপাঠকই। ইদানীং সেখানেও একটা বড় গোলমাল হচ্ছে। কোনো নতুন বইয়ের কেউ প্রশংসা করলে, বিশেষ করে যিনি পাঠক হিসাবে উচ্চমানের বলে আমার বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসে সে বই কিনেছি। পড়ে কেমন খটকা লেগেছে। সাথে সাথেই মনে হয়েছে এই প্রশংসা কোনো অনুরোধ বা উপরোধ বা give & take policy দুষ্ট নয় তো? অথবা মনে করেছি নিজের সাহিত্যমূল্য বোঝার ক্ষুদ্রসীমারেখায় হয়ত সে লেখা ধরা পড়েনি। মুষড়ে গেছি। আবার কালের চক্রে এমন কোনো বই হাতে এসে পড়েছে যা বিশ্ব-সাহিত্যে বেশ সম্মানের, তার রস বেশ আস্বাদন করতে পারছি, তখন মনে হয়েছে এই বই তবে তো বেশ বুঝতে পারছি, ওইটে কেন পারলুম না? কোনো বই পড়ে তার যথার্থ মূল্যায়নের জন্য প্রচুর জ্ঞান না থাকলেও, ‘আমার ভালো লেগেছে’ – এই কথাটা যদি নির্মোহ হয়ে, নিজের বিবেকের কাছে খাঁটি থেকে বলা যায়, তবে সাহিত্যের মাথায় রাজতিলক দেওয়ার সম্মান না পেলেও, তার পায়ে নিজের ভক্তি অর্ঘ্যটুকু শুদ্ধ থাকে। সেও বা কম কি?
        সাহিত্যের বাইরের দিকটায় দেশ-কাল-ভাষার একটা ঐতিহাসিক রূপরেখা থাকলেও, গভীরে যত যাওয়া যায় সে রূপরেখার মূল্য তত ক্ষীণ হয়ে আসে। কারণ ওই যে বললাম মানুষের চিত্ত একটা অমর সাগর। তার জল পুরোনো হয় না। ভাষা বদলায়, ভঙ্গী বদলায়, চরিত্রেরা বদলায় – কিন্তু সব সেই চিত্ত-সাগরের ক্ষণিক ঢেউ। সাগরেই মিশবে। পাঠক চিত্তের গভীরতম তল স্পর্শ করে আবার সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে। হাজার হাজার বছর আগে কোনো লেখকের চিত্তে জাগা এক ঢেউ আজকের পাঠকের চিত্তে জেগে ওঠে – এই সাহিত্যের ধর্ম। জীবাশ্ম যেমন তার বিগত প্রাণের একটা ক্ষয়িষ্ণু চিহ্ন কালের চাকায় পিষে যেতে যেতেও টিকিয়ে রাখে, কিন্তু প্রাণ পায় না, সাহিত্য সে জীবাশ্ম নয়। প্রাচীনত্বে তার ভাষা দুর্বোধ্য হতে পারে। কিন্তু সেই দুর্বোধ্য ভাষার পথ যদি একবার সুগম হয়ে ওঠে পাঠক সেই সাহিত্যে ডুব দিয়েও আবার নিজেকে সেই চিরকালীন চিত্তসাগরে পায়। অনুভব করে। তৃপ্ত হয়।
        তাই রবীন্দ্রনাথের কথায় অলসতায় সাহিত্য জন্মায় না, সাহিত্য জন্মায় অবকাশে। সেই অবকাশে আমার চিত্ত যেন আবিলতায় না ভরে ওঠে। আমি যেন সাহিত্যের রসদ খুঁজতে ভাগাড়ে না ঘুরে মরি। আমার আবেদন যেন প্রথমত আমার নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ হয়। বিবেক ছাড়া সংসারে আর যা কিছু চললেও চলতে পারে, সাহিত্য এক মুহূর্তও বাঁচে না। এমনকি ধর্মও যে বিবেক ছাড়া জীবিত থাকতে পারে তার উদাহরণ চতুর্দিকে। কিন্তু সৎসাহিত্য বিবেক আর অবকাশের যৌথ মিলনে গড়ে ওঠে। তার তাড়া নেই। তার লোভ নেই। তার আত্মাভিমান আছে, কিন্তু ক্ষুদ্র অহং-এর আবিলতা নেই। পৃথিবীতে সেদিন সত্য অর্থে দুর্দিন না, যেদিন ধর্ম বলে কিছু থাকবে না; পৃথিবীতে সেদিন সত্য অর্থে দুর্দিন যেদিন সৎ সাহিত্যের অভাব হবে। কারণ বিবেকের দায় একা সেই-ই নিঃস্বার্থভাবে বহন করে এসেছে। পাঠকের ইতিহাস সাক্ষী।