Skip to main content

 

002.jpg

কয়েক মাস আগে থেকে আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর থাকা শুরু করল। যাকে আমরা বাংলায় নেড়ি কুকুর বলি, ইংরেজিতে স্ট্রে ডগ, সেই প্রজাতির। মোটকথা কৌলিন্যহীন কুকুর। পুরুষ কুকুর। বয়েস হয়েছে। কিন্তু অসমর্থ নয়। সে প্রথম কদিন যখন থাকতে শুরু করল ভাবলাম হয় তো কদিনের অতিথি হয়ে এসেছে, চলে যাবে। তাকে বিস্কুট, ভাত, রুটি ইত্যাদি ইত্যাদি বাড়িতে যখন যেমন হয় দেওয়া হতে লাগল। সে মাঝে মাঝে পাড়া চরতে বেরোয়, আবার ঘুরে ফিরে বেশিরভাগ সময় এখানে এসে থাকতে শুরু করল।

মাস খানেক পর যখন বুঝলাম সে এখানেই থাকবে আমার মাথায় প্রথম যেটা এল যে এ কাউকে যদি কামড়ে দেয় আমার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে, তার দায়িত্ব কার? অবশ্যই আমার। তবে আমার হাতে দুটো উপায় ছিল, এক ওকে মেরেধরে তাড়ানো, অথবা ওকে ভ্যাক্সিনেট করা। প্রথমটা মানবিক কারণ সম্ভব নয় তাই দ্বিতীয়টার উপায়ের খোঁজ শুরু হল। খোঁজ নিয়ে প্রথম যেটা জানলাম খরচ খুবই সামান্য।

কিন্তু যতটা সহজ কাজটা ভেবেছিলাম, আদতে ততটা না কাজটায় নেমে বুঝলাম। যে কুকুরটা থাকতে শুরু করেছে তাকে খাবারদাবার দিলেও তার সঙ্গে এমন সখ্যতা নেই যে তাকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় আমি এমনভাবে ধরে রাখি যাতে সে কামড়ে না দেয়। আমি ফোনের পর ফোন শুরু করলাম, পাড়ার নেড়িকুকুর শুনেই সবাই প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ও তো কামড়ে দিতে পারে, আপনি ওকে ধরে রাখতে পারবেন? আমি বললাম, একদমই না। তার সঙ্গে আমার অতটাও গভীর পরিচয় নেই। তাছাড়া শারীরিকভাবে অমনভাবে পশু হ্যাণ্ডেলিং এও আমি পারদর্শী বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নই।

এদিকে বাড়িতে ইঞ্জেকশন চলে এসেছে। ফ্রিজে মজুত। দিলেই হয়। আমি ভাবছি কী করে সম্ভব এ কাজটা। কাজটা তো করতেই হবে। তখন দৈবযোগে আমার এক অনুজের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সে বলল, এই ব্যাপার? তুমি দুটো বিস্কুট নিয়ে এসো, আর যে ইঞ্জেকশন দেবে তাকে ডাকো। যে দেবে সেও আমার আরেক অনুজ। যে কাজটা নিয়ে এতদিন মাথাব্যথা করছিলাম, এক লহমায় সে কাজটা সমাধা হয়ে গেল সে দুজনের অসামান্য তৎপরতায় আর দক্ষতায়।

এ ঘটনার কয়েক মাস পর থেকে শুরু হল কুকুরে কামড়ানো ও মানুষের সুরক্ষার লড়াই, একদম খোদ সুপ্রিম কোর্টে। আমি প্রফেশনাল পশুপ্রেমী নই। গরু, কুকুর, ছাগল, মুর্গী, হাঁস, বেড়াল ইত্যাদি যত যত প্রাণী আছে কাউকে দেখলেই আমার বিবমিষা হয় না। আবার চূড়ান্ত প্রেমেও বিগলিত হই না। আমি “আদিখ্যেতা” শব্দটা ব্যবহার ইচ্ছা করেই করলাম না। কিন্তু একটা কথা মাথায় ঘুরতে লাগল, এই যে এত এত কুকুর, এদের ভ্যাক্সিনেট করাতে তো এমন কিছু খরচ হয় না। যদিও এই “এমন কিছু খরচ” কথাটা ভীষণ আপাত শব্দ। কিন্তু আমি যদি গামলা নিয়ে নানাবিধ খাবারদাবার নিয়ে রাস্তার মোড়ে ইত্যাদি জায়গায় তাদের নিত্য দুবেলা কী একবেলা খাওয়াতে পারছি দিনের পর দিন, তবে একজন প্রফেশনাল লোক ডেকে তাদের ভ্যাক্সিনেট করার কথাটা আমার মাথায় আসছে না কেন? আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা বললেন, সে দায়িত্ব আমার না।

এখন কথাটা হচ্ছে কুকুরকে ভালোবেসে, তাকে নাইয়েখাইয়ে আমার যে সুখ, সে অবশ্যই ব্যক্তিগত সুখ ও সে প্রেক্ষাপটে তা মূল্যবান। সে সুখটা হাতেনাতে পেয়ে যাচ্ছি। সে আমার ব্যক্তিগত সুখ। তৎক্ষনাৎ পাওয়া সুখ। কিন্তু পরের কাজটা সুখের সঙ্গে সম্পর্কিত না, দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। যে রাস্তার কুকুরগুলোকে আমি ভালোবেসে স্নেহপরায়ণ হয়ে খেতে দিচ্ছি রোজ, সে কুকুরগুলো যেন সমাজে থ্রেট না হয়ে যায় সেটা দেখাও যে আমার দায়িত্ব, সেটা বোঝাতে আমাদের আইনআদালত লাগে। এটাই আমার খুব আশ্চর্য লাগে। যদিও একটা জ্যান্ত মানুষকে চিতায় তুলে জ্বালাতে নেই, একজন অল্পবয়সে স্বামীহারা কন্যার দ্বিতীয় বিয়েতে বাধা নেই, বিয়ের সময় পণ নিতে নেই এইসব সামান্য কথাগুলো বোঝাতেও আমাদের আইন আদালতের দরকার হয়েছিল।

কথাটা হচ্ছে ভালোবাসার সঙ্গে দায়িত্ব যেটা বর্তায় সেটাকে পালন করলেই হয়। এখানে তর্ক আসতে পারে, যে খেতে দিচ্ছে সে-ই কেন এটা নিয়ে ভাববে, যে কুকুরপ্রেমী না, সেও তো এ কাজটার দায়িত্ব নিতে পারে সমাজের দিকে তাকিয়ে।

অবশ্যই পারে। পারা উচিতও। তর্কের দিক থেকে কথাটা যুক্তিযুক্তও। কিন্তু এ যুক্তির কথা শুধু না, তাগিদেরও। আমার বাড়ির নারকেলগাছটার নারকেল যদি রাস্তার দিকে ঝুঁকে পড়ে, সেটা কারোর মাথায় পড়ে যে কোনো বিপদ না ঘটে সে দেখার দায়িত্বও যেমন আমার। আমার বাড়িতে জমাজলে ডেঙ্গুর মশা জমে যেন পাড়ার বিপদ না ঘটে সেটা দেখার দায়িত্বও যেমন আমার, তেমন আমার সারমেয়সেবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমাজসেবার দায়িত্বও চলে আসে, সে মানুষ যতই ‘'বেইমান” হোক, আর কুকুর যতই ‘'লয়াল’ হোক। সমাজটা আদতে মানুষের লয়ালিটিতেই চলে, কুকুরের না।

কিন্তু আমরা ভাবিনি। তাই ঘটনাটা সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়ালো। যদিও কেরালা ইত্যাদি যায়গায় এ নিয়ে আগে থাকতেও কেস হয়েছে। কেরালা কোর্টই এ কথাটা প্রথম বলে যে যারা খাওয়াচ্ছেন তারা তাদের উপদ্রবের দায়িত্বও নেবেন।

সমস্যা ছিল। সমাধানও ছিল, যা এমন কিছু ব্যয়বহুলও নয় সবাই মিলে এগিয়ে এলে। কিন্তু কতগুলো তরতাজা প্রাণ চলে যাওয়ার পর এ কথাটা আলোচনায় এলো। রায় বেরোলো। চিরকালই কী আমাদের সাধারণ দায়িত্বগুলোকে এইভাবে চাবুকের আঘাতে মনে করিয়ে দিতে হবে? অকারণে হর্ন বাজাতে নেই, যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলতে নেই, আপনার সুখেদুঃখে লক্ষকোটি টাকা খরচ করে সামাজিক হওয়ার কোনো দায় নেই ইত্যাদি ইত্যাদি…..এ সব কি আমাদের মামলামোকদ্দমা করে বুঝতে হবে?

001.jpg