Skip to main content

 

বুঝলে বৌঠান, বাড়িতে এমন অশান্তিও নেই যে সেই অশান্তির দোহাই দিয়ে কদিন বাইরে থাকব…..

ভুট্টা সেঁকতে সেঁকতে হরিসাধন বলল।

হরিসাধনের বয়েস হয়েছে। রেলকলোনির মোড়ে প্রায় চল্লিশ বছর হল ভুট্টা নিয়ে ভ্যানে বসে। ভুট্টা না থাকলে কলা, লেবু নিয়ে বসে যায়।

কাঁকন সাইকেলে চারটে বড় বড় সাদা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে। চারটে ব্যাগের দুটোতে নানারকমের চানাচুর আর দুটোতে বড় বড় চায়ের ফ্লাক্স। এই করে ছেলেমেয়ে বড় করেছে। স্বামী থেকেও নেই। সে গল্প বলার জায়গা এটা নয়।

কাঁকন হাসলো হরিসাধনের কথা শুনে। ওরা পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছে প্রায় কুড়ি বছর হল। কথা হয় আবার হয়ও না। কিন্তু কথা হতে হতে ফুরায়ও না, আবার কথার চাপে মরেও যায় না।

রাত হল। কাঁকন ফিরছে। আকাশে চাপ চাপ মেঘ। এই সময়টা কাঁকনের গাইবার সময়। ডাকার সময়। সব হিসেবনিকেশের বাইরে যাওয়ার সময়। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে….হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে……কাঁকন ধীরে ধীরে গায় আর সাইকেলটা নিয়ে হাঁটে। চড়তে পারে না। শরীরটা ভারী হয়ে গেছে, তায় বাতের ব্যথা।

কাঁকন গাইছে আর হাঁটছে। সাইকেলের চাকার চিকচিক আওয়াজ যেন খঞ্জনির মত বেজে চলেছে। মেঘ ভাঙা চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে।

হঠাৎ কাঁকন দাঁড়ালো। হরিসাধনকে একটা কথা বলতে হবে।

কাঁকন ফিরল। হরিসাধনকে ক'টা কথা বলতেই হবে।

হরিসাধন সবে সব গুছিয়ে ফেরার তোড়জোড় করছিল। কাঁকন এসে দাঁড়ালো। বলল, সাধনদা?

হরিসাধন তাকে দেখে অবাক গলায় বলল, কী গো….এখন?

কাঁকন বলল, তোমার মনে কী কোনো চাপা ক্ষোভ আছে? যা উপেক্ষা করেছ আজীবন?

হরিসাধন চুপ করে থাকল। বড্ড অপ্রস্তুত লাগছে।

কাঁকন বলল, কী ক্ষোভ আমাকে বলতে হবে না দাদা, কিন্তু কাউকে তো বলতে হবে।

হরিসাধন বলল, এই কথাটা বলার জন্য আবার ফিরলে?

কাঁকন উতলা হয়ে উঠল। বলল, দাদা, এই ফেরার রাস্তাটুকু আমার তাঁকে ডাকার সময়। ফিরে তো আবার রান্না। তারপর চানাচুরের প্যাকেট বানানো। ডাকব কখন? সেই ডাকতে ডাকতেই যাচ্ছি, এমন সময় তোমার কথাটা মনে এলো। ক্ষোভ ধিকিধিকি জ্বলে সব জ্বালিয়ে দেয় দাদা। কাউকে জানাও তুমি।

হরিসাধন বলল, রাত হয়েছে, তুমি ফেরো কাঁকন, আকাশ জুড়ে কী মেঘ তো দেখছ। তুমি এই কথাটা বলার জন্য এই চারটে ব্যাগ নিয়ে আবার এতটা রাস্তা ফিরে এলে। এরপর আমার আর কী ক্ষোভ থাকতে পারে বলো। আর যদিও বা কিছু থাকে সে বলার লোকও তুমিই। শুনো না হয়। কিন্তু আজ ফেরো।

কাঁকন ফিরছে। মনটা শান্ত। শুধু শান্ত? একটা সরু সুতোর মত সুখ মেঘ ছেঁড়া চাঁদের আলোয় যেন শিশির মেখে জন্মাচ্ছে। কাঁকন ছাড়া আর কাউকে তার বলার নেই? কী সুখের কথা গো! কাঁকনের নামগানে এ কথাটা আখরের মত বেজে উঠতে লাগল বারবার।

হরিসাধন ফিরছে ভ্যান চালিয়ে। বুকটা হালকা লাগছে। কতদিনের বোঝা যেন নেমে গেল। ক্ষোভ? থাকলেই বা। বলার মত লোকও তো আছে। হরিসাধন গাইছে - “গৌরাঙ্গ বলিতে হবে রে পুলকশরীর….হরি হরি বলিতে নয়নে বহে নীর..”

এ গান কাঁকন গায়। একা একাই গায়। আজ হরিসাধন গাইছে। কবে শিখল নিজেও জানে না সে। তার পাশে পাশে যেন কাঁকন যাচ্ছে এ গান গাইতে গাইতে। সব ক্ষোভ প্রথম বর্ষার জলে ভেসে যাওয়া শুকনো তপ্ত মাটির মত বয়ে যাচ্ছে। হরিসাধন বলল, কী দিলে তুমি আমায় কাঁকন! কী দিলে গো!