মেলায় চারদিকে দেখি কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। উঁহু, বইমেলা নয়, গাজীর মেলা। চারদিকে ধানক্ষেত। মাঝে গাজীবাবার সমাধি। তারপাশে বিরাট প্রকাণ্ড এক গাছ। চারদিক থেকে ক্ষেতের আল দিয়ে, ক্ষেতের সব্জী তছনছ করে, ক্ষেতের সরু তারের বেড়া দুমড়ে মুচড়ে সার দিয়ে লোক যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে কেউ যাচ্ছে না। শর্টকাট হল আলের পথ। ফুলকপিগুলো ছড়িয়ে এদিক ওদিক। জায়গা? ওই কল্যাণী আর মদনপুরের মাঝে।
মেলায় নানারকমের খাদ্যসামগ্রী। মানুষ খাচ্ছে। ওদিকে গাজীবাবার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় খিচুড়ি আর পায়েস দেওয়া হচ্ছে। বিনা পয়সায়। যে যা হাতের কাছে পাচ্ছে, তাতে করেই সে সব নিচ্ছে, খাচ্ছে, আবার যাচ্ছে। বাবার দরগার উপর বসে, কেউ মাটিতে দাঁড়িয়ে দরগায় খিচুড়ি, পায়েস রেখে খেয়ে যাচ্ছে। ওদিকে দরগায় লাইন দিয়ে মানুষ আসছে, মুড়ি আর ফুল ছোটো ছোটো মাটির সরায় করে নিয়ে আসছে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। একজন আলখাল্লা পরা মানুষ তাদের সবার মাথায় চামর দিয়ে বুলিয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যে হল। মাইকে ঘোষণা চলছে, কেউ বাঁশি বাজাবেন না দরগায়। আল ধরে যারা আসছেন সাবধানে আসবেন, পড়ে যাবেন না।
বাঁশি? কাগজের বাঁশি। ছেলেরা ফুঁ দিলেই কান ফাটানো আওয়াজ। কে আর ঘোষণা শোনে। যে যার মত এন্তার সে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে এইসবের মধ্যেও মাঘীপূর্ণিমার চাঁদ উঠল পুবদিকে। চারদিকে ধানক্ষেত মুহূর্তে সাদা ধবধবে হয়ে গেল। গাজীবাবার সমাধির কাছে এসে দাঁড়ালাম। কে ছিলেন ইনি, জানি না। চারদিকে হিন্দু-মুসলমান সব মিলিয়েই তো দেখছি। পুলিশ চারদিকে আছে। পরিবেশ শান্ত। বেশ হইহই হচ্ছে চারদিকে। আনন্দের হাট। মেলা যখন থাকে না। তখনও আনন্দের হাট। অন্য আনন্দ। শান্তির আনন্দ।চারদিক তখন জন কোলাহল মুক্ত। শুধু পাখির আওয়াজ। শ্যালোর আওয়াজ। আর মাঝে মাঝে দূর দিয়ে ট্রেন যাওয়া শব্দ। তখন শুধুই নির্জনতা। তার মধ্যে শান্ত গাজীবাবার দরগা।
মেলায় দুটো জিনিসই দেখলাম। এক খিদে। দুই, আলো। যে মানুষ মোমবাতি জ্বালছে, প্রদীপ জ্বালছে, সে-ই খিচুড়ি আর পায়েসও খাচ্ছে। মাটিতে উবু হয়ে, সাইকেলের ক্যারিয়ারে রেখে, হাতে ধরে। মা ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে। ঠাকুমাকে নাতি খাইয়ে দিচ্ছে। এক বুড়ি চাঁদের আলোয় লাঠি হাতে ওই এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে মেলার দিকে এগোচ্ছে। তারও আলো চাই, চোখে। খাবার চাই পেটে। এখানে তর্ক নেই। হিংসা নেই। মতবিরোধ নেই। ভরা পেটে আলো নিভিয়ে দিলেই যত গোল। এ বলে আমি, ও বলে আমি। ব্যস, লেগে গেল কোন্দল।
মেলা থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলো ধানক্ষেতের উপর পড়েছে। চারদিকে তাকালে শুধু আকাশ আর আকাশ। এসব দেখতে কি ভুলে যাব আমরা? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? এই যে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে "আমাকে দেখো… আমাকে দেখো" বাতিক আমাদের রক্তে ঢুকে পড়ছে, পরবর্তী প্রজন্মেতেও চারিয়ে যাচ্ছে। এতে কি হচ্ছে? আরো অসন্তোষ বাড়ছে। মানুষ নিজেকে দেখিয়ে আর নিজেকে নিয়ে মেতে কবে সুখ-শান্তি পেলো। সুখ-শান্তি তো নিজেকে ছাড়িয়ে গেলে। কিন্তু এই সোশ্যালমিডিয়াকে আহাম্মকের মত আমরা যে অর্থে ব্যবহার করছি, সে তো খালি একপেশে। এতে সুখশান্তি কোথায়?
সুখ মানে, পেটে খিচুড়ি পায়েস, শান্তি মানে, আলো। বাকি যা তো মানুষ বানিয়েই নেয়। অশিক্ষা আর প্রাচুর্যের সমন্বয় পরমাণু বোমার চাইতেও ভয়ঙ্কর। গাজীবাবা এত এত মানুষকে ডেকেছেন। আজও ডাকছেন। বড়রা ডাকেন। নি:শব্দে ডাকেন। কানে কানে বলেন, ক্রমে তুমি শুধরে নেবে নিজেকে, আরো ভালো হবে, আরো ভদ্র হবে। এইটুকুই তো ধর্ম। ভালো হও, ভদ্র হও। একটু বুঝদার হও। হৃদয় দিয়ে বোঝো। দেখো সব সোজা। চাঁদের আলোর মত সোজা। সফেদ। আনন্দময়। বিষাদ কই?