"কতবার বলেছি তোকে হাগা পোঁদে পুজোর ফুল তুলবিনি…. তুলবিনি... সেই তুই…."
"আহা দিদি, মিথ্যা চটো... ভগবান পোঁদ দেখেন না, হৃদয় দেখেন…. পড়োনি শাস্ত্রে…. ঠাকুর রামকৃষ্ণও তো বলেছেন---"
কথাটা তো ঠিক। কিন্তু লোকাচার আর দর্শন কি একযোগে সংসারে থাকে? একজন থাকে বদ্ধ হয়ে বই আর আলোচনায়। আরেকজন মোড়লি করে সংসার চালায়। তাই লোকাচারকে সবাই চেনে, মানে। ওইতেই সব।
গজগজ করতে করতে রজনী ঢুকে গেল ঘরে। কে ওর সঙ্গে এখন লাগতে যায়? আর যত দিন যাচ্ছে তত যেন সৃষ্টিছাড়া হচ্ছে। পাড়ার কুকুর আর ঠাকুরঘরের ঠাকুর... এই নিয়েই পড়ে থাকে মুক্তা। কিন্তু ওর ভক্তিকে দেখলে ভয় পায় রজনী। ওকি আলুথালু ভক্তিরে বাবা? মুক্তা চোখ বন্ধ করে যখন ঠাকুরের সামনে বসে থাকে, রজনী গুটিগুটি পায়ে নিজের মনের বিরুদ্ধেই যেন যায় ঠাকুরঘরের দিকে, উঁকি দিয়ে দেখে আসে মাগীকে। বিধবা, নিঃসন্তান এ মফঃস্বলে কম নেই, কিন্তু তার ননদের মত একটাও নেই। রজনী বুঝে পায় না, সে গর্ব করবে, না লজ্জা পাবে।
মুক্তা সুন্দরী না। তার উপর মুখরা। এমন সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি সংসারে এনে বিধাতা যে কি আনন্দ পান রজনী মাঝে মাঝে ভাবে। রজনী মুক্তার ছন্দকে যত এড়িয়ে যেতে চায় তত যেন বেশি করে ধরা পড়ে। সংসারে মানুষ বলতে মুক্তা, রজনী আর রজনীর ছেলে নবীন, ক্লাস নাইনে পড়ে। রজনীর স্বামী বাইরে মুম্বাইতে থাকে। বছরে শুধু পুজোর সময়টুকু আসে। সংসার সচ্ছল না হলেও অভাবপীড়িতও নয়।
রজনী স্নান করে কাপড় কেচে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে দেখে মুক্তা কার সঙ্গে একটা বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। রজনী একটু এগিয়ে এসে বুঝতে চেষ্টা করল ছেলেটাকে চেনে কিনা। না, চেনা তো মনে হল না। মুক্তা এখানে একটা স্কুলে সেলাই শেখায়। সেখানকার কেউ কেউ মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু এ তো চেনা মুখ না!
রজনী রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল চাপালো। এই সময় সে আর মুক্তা চা নিয়ে রান্নাঘরের সামনে বসে। কত গল্প হয়। একই গল্প নিজেরাই কতবার বলে, কতবার শোনে। পুরোনো হয় না। মেয়েমানুষের হৃদয় পুরোনো হয় না, পুরুষের হৃদয় পুরোনো হয়ে যায়, তাই বয়েস হলেই নতুন হৃদয় খোঁজে। মুক্তা বলে। রজনী হাসে। ভয় হয়। তবু হাসে। বিকাশের চোখে চাতুরী আছে। বিকাশ তার স্বামী। কি যেন ওর রহস্য। রজনী যেন জানে বিকাশের সংসার আছে মুম্বাইতে। রজনী অন্যমনস্ক হয়। মুক্তা ধোঁয়া দেয় তার আশঙ্কায়। "ছাড়ো তো, দাদাটা চিরকাল মেয়েবাজ…. আমাদের এখানকার মেয়েগুলোকে কম জ্বালিয়েছে….."। রজনী হাসে। নিজের ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে হাসে। ভালোবাসার মানুষের মার যেন হাত-পা বাঁধা মানুষকে মারা। যে চাইলে প্রত্যাঘাত করতে পারে না। রজনীর হাত পা জিভ মন বুদ্ধি --- সব বাঁধা। ভালোবাসায়।
মুক্তা এসে বলল, কি গো এসো। চা বসিয়েছ?
রজনী দু'কাপ চা নিয়ে বসল বারান্দায়। বুকটা ধড়ফড় করছে। মুক্তা কি ওকে বিয়ে করে চলে যাবে? এ ভয়টা কেন হয় রজনী বোঝে না। কিন্তু এ সংসারে ভরসা যেন তার বিকাশে না, মুক্তায়। বিকাশ তাকে ছেড়ে যাবে তবু সে ভাবতে পারে, কিন্তু মুক্তা তাকে ছেড়ে যাবে এ ভাবনা তার অসহ্য। তার রাগ হয়, অভিমান হয়, কান্না পায়। এখন যেমন হচ্ছে। আর এরকম হলে বাইরে খুব কঠিন হয়ে যায় রজনী।
কে ছিল?
আরে প্রসূন গো... আমাদের সঙ্গে স্কুলে পড়ত…. বাইরে ছিল... এখানে এসেছে, আমাদের পোস্ট অফিসে বদলি হয়েছে….
অ…. বিয়ে হয়েছে?…..
মুক্তা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সরাসরি তাকালো রজনীর মুখের দিকে। রজনী ইচ্ছা করে যেন বাইরের রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। চোয়ালদুটো শক্ত। এ ভাব মুক্তা বোঝে। একবার ইচ্ছা করল রাগায়। কিন্তু মনের সে শক্তি বা ভাব কোনোটাই নেই এখন। প্রসূনকে সে ভালোবাসত। বাবা মেনে নেননি। তারা ব্রাহ্মণ নয় বলে। আজ মনটা বড্ড বিকিয়ে আছে। একটু আঘাতেই যেন কান্নায় ভেঙে পড়বে। কিন্তু প্রসূনের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর তার মত বাঁজ বিধবাকে বিয়েই বা করবে কেন সে? তার ভয় হয়, বৌদি যদি মুম্বাইতে চলে যায় দাদার কাছে তবে সে বাঁচবে কি করে? অবশ্য সেখানে যাওয়ার মত না অবস্থা আছে, না ইচ্ছা আছে বৌদির। আর বৌদির বাপের বাড়ি বলতেও কেউ নেই। তবে?
মুক্তা বলল, তুমি অকারণে কেন ভাবো এত... আমি কোত্থাও যাব না…. তোমায় চিতায় তুলে তবে কাশী যাব…..
রজনীর নীচের ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। মুহূর্তে চোখের কোল ভিজে প্রথম বর্ষার বৃষ্টির মত গালের উপর দিয়ে জল গড়িয়ে নামতে শুরু করল…. মুক্তা বলল, ছিঁচকাঁদুনে মাগী….
ছিঁচকাঁদুনে ঠিক না রজনী। আসলে এত কিছুর জন্য কান্না বাকি আছে যে সারাটা জীবন বড্ড কম হয়ে যায়। তাই একটু সুযোগ পেলেই কান্নাটাকে আটকায় না রজনী। এখনও কিছু বলল না এই বিষয়ে। শুধু চোখটা মুছে বলল, ভাত খেয়ে স্কুলে যেও... আজকে তো আবার টিউশান পড়িয়ে ফিরবে... বিকাল হবে….
মুক্তা সেলাই স্কুল থেকে ফেরার সময় কয়েকটা টিউশান করে। রোজ না। এই সপ্তাহে চারদিন।
মুক্তা 'আচ্ছা', বলে স্নানে গেল। রজনী রান্নাঘরে গিয়ে সদ্য ভাতের হাঁড়িটা নামিয়েছে, এমন সময় রান্নাঘরের সামনে ভূতের মত এসে বিকাশ দাঁড়ালো।
২
===
বিকাশের প্রাণশক্তি ফুরিয়ে আসছে। কথাটা পাঁচকান পাড়ায় না হলেও, লোকের বুঝতে অসুবিধা হল না যে বিকাশ আর সে বিকাশ নেই। রুগ্ন, চোখদুটো কোটোরে। দু'পা হাঁটতে গেলে বুক টেনে টেনে শ্বাস নেয়। ছেলেটা কাছে গেলে মুখ করে। রজনী পাশে গেলে মুখ ঝামটা দেয়। মুক্তা অবশ্য দাদার ছায়াও মাড়ায় না। বিকাশের শরীরে এইচ আই ভি ভাইরাসের বংশ বাসা বেঁধেছে। পাড়ার জটিলেশ্বর ডাক্তারের ওষুধ আনতে যায় বিকাশ নিজেই। অনেক পুরোনো হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। চোখে ভাল দেখেন না। কানে যা শোনেন তাইতেই ওষুধ দেন। তবে সেই কানে শোনার উপর না উনি ভরসা করেন, না ওনার রুগীরা। তাই এখন বড় কেউ একটা যায় না। বিকাশ আর উনি অনেকক্ষণ গল্প করেন। বিকাশের রোগটা একটা দুর্বলতা। অজীর্ণতা থেকে এসেছে। সেই চিকিৎসাই জটিলবাবু করে যাচ্ছেন। বিকাশও জানে এতে কিছু হওয়ার নয়। তবু মনের শান্তি।
রজনীর দিন-রাতের ছন্দ বদলে গেল। ভালো হল না খারাপ হল রজনী বোঝে না। মুম্বাইতে তার কোনো সতীন আছে কিনা সে প্রশ্নও করে না। রজনী জানে এ মানুষটা বেশিদিন নেই আর। বিকাশের কাছ থেকে ভালোবাসা পায়নি কোনোদিন রজনী। কিন্তু ভালোবেসেছে সবটুকু দিয়েই। নিজের কাছেই নিজের আদিখ্যেতা মনে হয়েছে তার এই কাঙালপনায় বিকাশের প্রতি। আবার মনে হয়েছে, মানুষের জীবনে সব কিছু এত হিসাব করে হয়? মানুষের জীবনে কিছুই কি হিসাব করে হয়? এই যে জবাগাছটা সে লাগিয়েছে, বলতে পারবে মাসে ক'টা করে জবা সে পাবে? সবই কালের মর্জি। মানুষের হাতে কি? ওই রেখায় কি লেখা থাকে? কিস্যু না। শুধু কাটাকুটি। মানুষের জীবন মানে কাটাকুটি।
রাতে বিকাশ ঘুমায় বারান্দায়। রজনী রাতে কতবার যে ওঠে। ঘুমন্ত বিকাশের পাশে দাঁড়ায়। ইচ্ছা হয় রোমশ বুকটায় মাথা দিয়ে জড়িয়ে শোয়। সিনেমার মত বলে, ওগো আমাদের না হয় একসঙ্গেই এ রোগ হোক। তবু তুমি আমায় নাও। শরীর জ্বলে যায় রজনীর। যেন কাটা পুকুর। জল নেই। মাটি ফাটছে রোজ একটু একটু করে। সেই ফাটা মাটিতেই তলিয়ে যাবে রজনী একদিন। মুক্তার শরীর এত ঠাণ্ডা কি করে হয়? কি পাষাণ মেয়েমানুষ রে বাবা! অবশ্য প্রসূন এলে ওর মুখটা কালো হয়ে যায়। রজনীর কান্না পায়।
সে যাক, মুক্তার কথা থাক। বিকাশকে ঘুমন্ত দেখলে কি অসহায় লাগে! কি অসাড়ে ঘুমায় মানুষটা। আঙুলগুলো কাঠির মত। বুকটা পিঁড়ির মত এইটুকু হয়ে আছে। চোখটা অর্ধেক খোলা। থাকবে না মানুষটা…. বিষ বাসা বেঁধেছে। বেশ করেছে, যা করেছে বেশ করেছে। শরীর পুড়িয়েছে, যার কাছে ভালো লেগেছে গেছে। সে তো ছিল না ওখানে, তবে? তার কি সাজে বিকাশের দোষগুণ বিচার করার? সে মেয়েমানুষ তায় পারে না। সে সুযোগ থাকলে সেকি যেত না?
তবে এ মনের ভাব রজনীর দিনের বেলায় থাকে না। দিনের বেলায় মানুষের মন অনেক ভীতু। আগে বুঝত না রজনী। আগে ভাবত রাতের বেলায় মানুষ বেশি ভীতু হয়। রাতের বেলায় মানুষ ভয় পায় অন্ধকারকে। সেটা বাইরের। দিনের বেলায় মানুষ ভয় পায় নিজের ভেতরকে। সমাজ নেই? দিনের বেলায় বিকাশকে দেখলে এক-একসময় তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়। এটা-ওটা কথা তুলে অকারণে বাড়ি মাথায় করে রাখতে চায়। বিকাশ কোনো উত্তর করে না যতক্ষণ রজনী দূরে দূরে থাকে। কাছে গেলেই বিকাশ আবার খেঁচিয়ে ওঠে। মুখ ঝামটা দেয়। রজনীও চেঁচায়। জোরে জোরে চেঁচায় যাতে মুক্তার কানে কথাগুলো যায়।
আসলে ইদানীং মুক্তা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে খুব। প্রায় কোনো কথা বলে না সারাদিন। আরো কতগুলো পড়ানো নিয়েছে। এখন রোজ সেলাইয়ের স্কুল থেকে দেরি করে বেরোয়। পড়াতে যায়। রাতে বাড়ি ফেরে। সকালটা ঠাকুরঘর নিয়ে পড়ে থাকে। কেন এরকম হয়ে যাচ্ছে মুক্তা, রজনী ভেবে পায় না। দাদার জন্য না প্রসূনের জন্য? জানে না। জিজ্ঞাসাও তো করা যাবে না। আর মেয়েটা তো মুখ ফুটে বলবেও না কিছু। রজনী একবার বলতে গিয়েছিল, এত পরিশ্রম কেন করছ মুক্তা... শরীর টিকবে না যে! মুক্তা বলেছিল, সংসারের খরচ তো বেড়েছে বৌদি। ব্যস... আর কোনো কথা নয়। রজনী দাঁড়িয়েছিল, অপেক্ষা করেছিল মুক্তা কিছু অন্তত বলুক। আসলে রজনী মনে মনে একটু সান্ত্বনা চাইতে গিয়েছিল। নিজেও খুব স্পষ্ট করে যে জানত তা নয়। যখন একটা সান্ত্বনার কথাও বলল না মুক্তা, তখন তার কান মাথা বুক জ্বলে গেল। একটা সান্ত্বনার কথাও কি বলতে নেই? কি পাষাণ রে বাবা! ভাগ্যে প্রসূণ এর পাল্লায় পড়েনি। হঠাৎ প্রসূনের উপর নিজের এই দরদ দেখে রজনী নিজেই অবাক হয়ে গেল। মুখে শুধু বলল, সেই তো, রোজগার ক্ষমতা আমার তো আর নেই…. তোমার টাকাতেই গিলি আমরা এখন... আমার যা ভাগ্যি….
মুক্তা রজনীর স্বভাব জানে। কোনো কথা আর না চলে গিয়েছিল। রজনী কেঁদেছিল অনেকক্ষণ ঠাকুরঘরে বসে। মুক্তার ঠাকুর, মুক্তার মতই পাষাণ। না, মুক্তা পাষাণ হয়েছে এই ঠাকুরকে দেখে দেখেই।
৩
===
বিকাশ মারা গেল না। হারিয়ে গেল। দু'দিন ধরে টানা বর্ষা চলছে। রজনী বারবার করে বলছিল তুমি ঘরে এসে শোও, আমি আর বাবু ঠাকুরঘরে শুয়ে যাচ্ছি। বিকাশ 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলেনি। কাশিটাও খুব বেড়েছিল এর মধ্যে। ওষুধ আনতেও যাচ্ছিল না। একদিন সকালে রজনী দেখল বিকাশ নেই। মনটায় এক মুহূর্তের জন্য কু ডাকলেও পাত্তা দেয়নি। কিন্তু রাতেও যখন ফিরল না, তখন বুঝতে পারল বিকাশ পালিয়ে গেছে। রজনীর রাগ হল। এতদিন ধরে মনে মনে নিজেকে আসন্ন বৈধব্যের জন্য তৈরি করে নিচ্ছিল। সবার কপালে সুখ হয় না, কিন্তু মুক্তি তো পেতে পারে। মুক্তিতে সুখ না থাকুক, শ্বাস তো নেওয়া যায়! বিকাশ না দিল তাকে বৈধব্যের মুক্তি, না দিল সুখ। ক'দিন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকল। কিন্তু মেজাজ তিরিক্ষি হলেই বা কি। বাড়িতে কে আছে তার মেজাজের খোঁজ নেওয়ার? ছেলেটা বারমুখো। মুক্তা নিজের মত নিজের জগতে। তা ছাড়া ওদের সেলাইয়ের স্কুলে পার্টি নিয়ে কি সব ঝামেলা হচ্ছে। স্কুলটা যে ক্লাব চালায় সেই ক্লাবের রং বদলে গেছে। সবাইকে ওই দলের সদস্য হতে বলা হচ্ছে। কিন্তু মুক্তা আর দু'জন দিদিমণি রাজী নয়। ইদানীং বাড়িতে দুই পার্টির ছেলেরাই আসে। ঘরে ঢোকে না কেউ। বাগানেই কথা হয়। মাঝে মাঝে মুক্তার ঝাঁঝালো গলার আওয়াজ পায় রজনী ঘর থেকেই। উঁকি মেরে দেখে জানলা দিয়ে। ভয় হয়। আগে প্রসূন আসত মাঝে মাঝে। ওর বিয়ের পর ও আসা কমিয়ে দিয়েছে। প্রায় আসে না বললেই চলে।
একদিন মুক্তা রাতে বাড়ি ফিরল না। রজনীর কাছে তেমন কারোর নাম্বার নেই। অবশেষে প্রসূনকেই ফোন করল। প্রসূন সব শুনে 'চিন্তা কোরো না বৌদি, আমি দেখছি', বলে ফোন রেখে দিল। আর সারারাত ফোন করল না। রজনীও আর লজ্জায় ফোন করতে পারল না। হাজার হোক বিয়ে হয়ে গেছে এখন। ভাবতে ভাবতে রজনীর কখন চোখ লেগে এসেছে জানেই না। ঘুম ভাঙল একটা ভীষণ চ্যাঁচামেচিতে। চোখ খুলে দেখে বাড়ির উঠানে থিকথিক করছে লোক। তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে পাড়ার অনেক বউ-মেয়ে। একটা পুলিশের গাড়ি থামল এসে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল রজনীর, তাই তো! কাল রাতে মুক্তা বাড়ি ফেরেনি। ওর কি কিছু!
মুক্তার নগ্ন দেহ রেললাইনের ধারে পাওয়া গেছে। শরীরে অত্যাচারের ছাপ স্পষ্ট। মুক্তাকে ধর্ষণ করে, রেললাইনের ধারে ফেলে রেখে গেছে।
এরপর কয়েক মাস কি করে গেল রজনী নিজেও জানে না। দিন-রাত, মেঘ-রোদ প্রকৃতির নিয়মে ঘটে চলল। কিন্তু সে সবের সঙ্গে রজনীর কোনো যোগাযোগ থাকল না। সারাদিন বাড়িতে নয় পুলিশ, নয় খবরের কাগজের লোক, নয় পার্টির ছেলেরা আসতেই আছে। পুরুষ মানুষের নজর যে এত খারাপ আগে বোঝেনি রজনী যেন। বিয়ে হয়েছে পনেরোয় পড়তে না পড়তেই। বিকাশ ছিল সাত-আট বছর এখানে। তারপর বিধবা হয়ে মুক্তা এল। বিকাশ মুম্বাই গেল। আর বাইরেটা সামলালো মুক্তা। রজনী এই প্রথম যেন এমন বে আব্রু গোটা সংসারের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজেকে নিয়ে যে কি করবে ঠাহর করতে পারে না। এতরকম হাতছানি, এত রকমের উস্কানি, মানুষ কতদিন এড়িয়ে যায়? শুধু কি বাইরের এই সমস্যা? কয়েক মাস পরে যখন সব থিতালো একটু রজনী নিজের নিঃসঙ্গতাকে টের পেল।
রজনী এখন সম্পূর্ণ একা। নবীনের জগতে তার কোনো ঠাঁই নেই। একা একা বাঁচতে শিখছে এখন। কয়েক বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করল প্রথম ক'দিন। তারপর? বাড়ি ফিরে কি করবে? গোটা বাড়ি যেন তাকে গিলে খেতে আসে। পাগল হয়ে যাবে এভাবে থাকলে সে। কিন্তু কি করবে? কাউকে তো চেনে না। কার কাছে যাবে? আবার মনে এল প্রসূনের কথা। পোস্ট অফিসে দুপুরের দিকে গেল। অপেক্ষা করল কখন ফাঁকা হয় প্রসূন। প্রসূন ফাঁকা হতে নিজেই এগিয়ে এসে বলল, কি হল বৌদি? সব ঠিক আছে?
এই প্রশ্নটা কতদিন পরে শুনল রজনী। গলা বুজে এলো কান্নায়। কিন্তু এই হাট-বাজার কি কান্নার জায়গা? নিজেকে সামলে যতটা নিজের ভাষায় কুলালো বুঝিয়ে বলল।
দু'দিন পরে প্রসূন তাকে এক আয়া সেণ্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। এ কাজ সে কোনোদিন করবে ভাবেনি। অচেনা লোকের হাগা-মোতা পরিষ্কার? তার মত পিটপিটে মানুষের? প্রথম প্রথম অসুবিধা খুব হচ্ছিল। এক বুড়ির দেখাশোনা করার কাজ। সে না পারে কথা বলতে, না পারে নড়াচড়া করতে। সারাদিন হাঁ করে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। রজনী একটা চেয়ারে বসে সারাটা দিন কাটিয়ে দিত প্রায় প্রথম দিকে। দিন যত গেল বুড়িটা যখন অভ্যাসে এসে গেল তখন আর সারাদিন বসে থাকে না। পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে নেয়। বুড়িটা মুখে আওয়াজ করলেও যায় না। সবার সব ডাকে সাড়া দেবে না ঠিক করেছে এখন সে। আগে নিজেরটা দেখবে। ক্রমে আয়া সেন্টারে কথা বলে চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি করে নিল। নাইট শিফটেও সে-ই থাকবে। বুড়িটার সঙ্গে একা একাই কথা বলে যায়। হাসে কাঁদে, যা করে একা। বুড়িটাকে মুক্তার গল্প বলে, নবীনের গল্প বলে, বিকাশের গল্প বলে। নিজের ছোটোবেলার গল্প বলে। এক-একসময় মনে হয় যেন পাগল হয়ে যাবে।
কিন্তু হল না পাগল রজনী। তবে নিজেকে ধরে রাখার অমানুষিক চেষ্টাটাও ছেড়ে দিল। আয়া সেণ্টারের মালিকের ছেলের সঙ্গে দীঘা ঘুরে এসেছে। কাজের বাড়িতে জেনেছে ছেলের জ্বর তাই আসবে না। আর বাড়িতে নবীন তো জানে মা আসেই না বাড়ি। মালিকের ছেলেটা ভালো, মিথ্যা হৃদয়ের অভিনয় করে না। শরীরটুকুই চায়। রজনীও ওইটুকুই চায়। হৃদয় সংসারে বাড়তি জিনিস। বোঝা বাড়ায় শুধু। অত বোঝা নিয়ে মানুষ বাঁচে!
একদিন কাজের বাড়িতেই দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে উঠেছে। হঠাৎ কলিং বেল বাজল। রজনী সাড়া দিল না। সেলসের লোকেরা হবে। বিরক্ত লাগে। সাড়া দিল না। এক মিনিট পরে আবার বাজল। সাড়া দিল না। ক'বার বাজিয়ে চলে যাবে। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে যখন আবার বাজল, রজনীর ভুরুটা কুঁচকে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখে প্রসূন। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। নবীনের কিছু হল..?
প্রসূন বসার ঘরে এসে বসল। তার হাতে একটা পোস্টকার্ড ধরিয়ে বলল, পড়ো।
রজনী দিদিভাই,
আমায় তুমি চিনবে না। আর চেনাচেনির সময়ও আমার নেই। তোমার স্বামী আমার কাছে এসেছে মরেছে আজ কয়েক মাস হল। আমাকেও সেই রোগ দিয়ে গেছে। তোমার কাছে যখন গেছিল তখন থেকেই আমি অসুস্থ। আমার জীবন এমন কিছু না গো, চোখ বুজলে আমার কোনো আক্ষেপও নেই। কিন্তু ওই এক পেটের শত্রু। ও তোমারও মেয়ে হয় দিদিভাই। কুঞ্জ। আমি চাই না ও মায়ের লাইনে আসুক। বড় জঞ্জাল হয়ে বেঁচেছিলাম দিদিভাই। মেয়েটাকে এই রাস্তায় আনতে চাই না। ও মারা যাওয়ার আগে তোমার ঠিকানা দিয়ে গেছে। বলেছে তুমি খুব ভালো। আমার মেয়েটাকে তুমি বললে ট্রেনে তুলে দি। আমার ফোন নাম্বার দিলাম। যদি ফোন করো জানব মেয়েটার আমার হিল্লে হল। না করলেও আমি কিছু মনে করব না দিদিভাই। রাস্তার আবর্জনা কে আর ঘরে তোলে?
প্রণাম নিও। ইতি তোমার অভাগা বোন, ফরজানা।
চিঠিটা পড়ে কেন চোখে জল এলো বুঝল না রজনী। প্রসূনকে বলল, তুমি পড়েছ, না?
প্রসূন বলল, হ্যাঁ। কি করবে? ভাবো দু'দিন। ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বোসো না।
রজনী শুনল কি শুনল না প্রসূন বুঝল না। রজনী হঠাৎ বলল, ওদের আসল নাম তো হয় না, না? তোমার ফোনটায় এ নাম্বারটা ধরে দেবে?
প্রসূন বলল, ঝোঁকের মাথায় কিছু ভেব না বউদি….
রজনী হঠাৎ বলল, মুক্তার ওই সময়ে খুব কষ্ট হয়েছিল না… বলো….
কথা শেষ হল না। রজনী হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। এত কান্না সে কোনোদিন কাঁদেনি…. কোনোদিন না…
(ছবি - Suman Das)