Skip to main content

 

শুভ বিজয়া জানানোর জন্যেই কল করেছিলাম মৌমিতাকে। সুজয় বলল, ও ওর বাবার বাড়ি আছে। বিকেলে ফাঁকা থাকলে আয়, বলছি।

সুজয়ের বাড়ি সোমরাবাজারে। হালিশহর থেকে সোমরাবাজার পৌঁছাতে সময় লাগবে জেনেই দুপুর দুপুর বেরোলাম। গোটা পুজোই মেঘলা কেটেছে। আজও মেঘলা। ওদের বাড়ি পৌঁছালাম বিকেল চারটে নাগাদ। বাড়িতে একাই থাকে। দোতলা বাড়ি। বাবা-মা কেউ নেই। সুজয় স্কুলটিচার। আমরা দু'জনে দু'কাপ চা নিয়ে বসলাম। এটা আমাদের অনেক পুরোনো অভ্যাস। মৌমিতা আমার কলেজের বন্ধু। সুজয়কে পরে চিনেছি। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব খুব তাড়াতাড়িই বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। আমি যখন আসা শুরু করি সুজয়ের মা বেঁচে ছিলেন। ভীষণ স্নেহ করতেন আমাকে। যা হোক ঘটনায় আসি।

সুজয় বলতে শুরু করল। ওর ভার্সনেই বলছি--

অষ্টমীর দিন আমরা ঠিক করলাম কল্যাণীর আইটিআই-এর ঠাকুরটা দেখতে যাব। বিকেলেই বেরোনোর কথা ছিল। কিন্তু যা বৃষ্টি শুরু হল বেরোতে বেরোতে আমাদের আটটা বেজে গেল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর আমাদের পাশ থেকে একটা বাইক ভীষণ জোরে একদম গা ঘেঁষে পাস করে গেল। ভাবলাম ড্রিঙ্ক করে চালাচ্ছে বোধহয়। এই সময় তো এটা কমন। বিরক্তিই লাগল। একটু পর আমরা দাঁড়ালাম। চা খাব। একটা দোকান আছে আমাদের দু'জনেরই ওদের চা খুব প্রিয়। দোকানে লোক নেই তেমন। আমরা দু'জনেই চা নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি, হঠাৎ আবার পাস করে গেল একটা বাইক। মৌমিতা বলল, আরে ওরাই তো!

আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। একটা মেয়ে পেছনে। মনে হল ওই বাইকটাই। মেয়েটা জিন্স পরেই ছিল মনে হল।

আমি বললাম, কিন্তু ওরা এগিয়ে গিয়েছিল না?

মৌমিতার কপালে ভাঁজ পড়ল। বলল, তাই তো!

যা হোক। আবার শুরু করলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার ধারে বাইকটা দাঁড়ানো। ছেলেটা আর মেয়েটা বাইকেই বসে। আমি ইচ্ছা করেই স্লো করলাম। কিন্তু ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও ওরা তাকালো না দেখে ভাবলাম নেশাটেশা করবে হয় তো।

আবার কিছুটা যেতেই আমাদের পাশ দিয়ে ওরা যখন পাস করছে তাকিয়ে আশ্চর্য হলাম মাঝে বসে আছে একটা বাচ্চা ছেলে। ছেলেটার পিঠে মাথা রেখে। কিন্তু ও এলো কোথা থেকে?

মৌমিতা বলল, খেয়াল করলে?

আমি বাইকটা দাঁড় করলাম সাইডে। কিছু একটা গোলমাল তো লাগছে। পুলিশে জানাব কিনা একবার মাথায় এলো। কিন্তু মনে হল বেশি ভাবছি। মৌমিতাকে এটাসেটা বলে আবার স্টার্ট করলাম।

কিন্তু এবার সত্যিই ঘাবড়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটল। হঠাৎ মনে হল মেয়েটা আর ছেলেটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। মৌমিতা বলল, দেখলে? দেখলে?

আমি দেখেও অনেকটা এগিয়ে গেছি। কিন্তু কী মনে হল বাইকটা ঘোরালাম। আগের জায়গাটা আন্দাজে গেলাম। অত অন্ধকারে জায়গাটা চেনা শক্ত। কিন্তু কোথাও তো কিছু নেই? এই রাস্তা দিয়ে প্রচুর গাড়ি যায় তুই জানিস। কিন্তু সেদিন আমাদের দু'জনেরই মনে হচ্ছিল গাড়ি যেন কিছুটা কম।

আবার এগোতে শুরু করলাম। কিন্তু মাথাটা কাজ করছে না। আমি বললাম, সামনে চায়ের দোকান পেলে দাঁড়াব বুঝলে। মাথাটা ধরে যাচ্ছে। একটু ছাড়াতে হবে।

কথামত আমি চা আর সিগারেট নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। মৌমিতা দোকানের ভেতরে। ও একটা কোলড্রিংক্স নিয়েছে। কী বলব তোকে আচমকা দেখি বাইকটা পাস করছে, মাঝে বাচ্চাটা আবার…. আর বিশ্বাস করবি না…. ওরা তিনজনেই এদিকে তাকিয়ে…. আমার দিকে! আমার সারাটা শরীর দিয়ে যেন বরফের স্রোত নেমে গেল। মাথাটা পুরো ব্ল্যাংক। মনে হল এক্ষুনি ফিরে যাই। কিন্তু সাহস হল না। আবার এগোতেও সাহস হচ্ছে না।

মৌমিতা আমার সামনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। আমাকে বলল, ঘামছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

ওকে কী বলব? কিছু না বলে আবার শুরু করলাম। কতক্ষণ চালিয়েছি মনে নেই, হঠাৎ ও চীৎকার করে আমার কাঁধটা খামচে ধরল…. সুজয়…. সুজয়…..

আমি গাড়ি থামালাম। ও লাফ দিয়ে নামল। আমি দেখি রাস্তার একটা মোড়ে ওদের বাইকটা পড়ে। ওরা তিনজন ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। এত রক্ত আমি একসঙ্গে দেখিনি। আমার মাথাটা ঘুরে গেল। চোখে অন্ধকার দেখে আমি বসে পড়লাম। মৌমিতা কিছু বলছে আমাকে বুঝতে পারছি, কিন্তু সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুয়ে পড়লাম।

খানিকবাদে চোখ খুলে দেখি মৌমিতা আর পাশে দু'জন ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে। আমার সারাটা গা ভিজে, মাথা ভিজে।

ভদ্রলোকের মোড়ের পাশেই দোকান। মুদির দোকান। পাশে ওর শালা। পুজোতে এসেছে। শিলিগুড়ি থাকে। ওর মুখেই শুনলাম।

গতবার পুজোয় এই মোড়েই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। বাচ্চাটা স্পট ডেড। বউটা আর লোকটা দু'দিন বেঁচে ছিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ওরা যা জানায় তা হল, লোকটা নাকি বাইক চালাতে চালাতে অনলাইনে অর্ডার করছিল। তার কারণ ওর স্ত্রী বলেছিল, এই অফারটা বেশিক্ষণ নেই। তাড়াতাড়ি করতে। সামনে দিয়ে এই বাঁকটা থেকে একটা সুমো ঘুরছিল ওরা খেয়ালই করেনি।

মৌমিতা নিজের মনে মনেই বলল, ওদের কারোর মাথাতেই হেলমেট ছিল না, না?

এরপর থেকে ওর নার্ভাস ব্রেকডাউন মনে হয়। ও বাড়ি গিয়ে থাকতে চাইল ক'দিন। আমিও বললাম, তাই যা।

বাড়ি ফিরলাম। মৌমিতাকে ফোনে পেলাম রাতের দিকে। ফোন ঢুকছিলই না। আমি কিছু বলার আগেই বলল, সরি রে সরি…. তোকে বলে আসতে পারিনি….. আমি আর সুজয় ট্রেকিং-এ এসেছি।

আমি একবার মোবাইলের স্ক্রিনটা চেক করলাম। মৌমিতাই তো। আমি রেখে দিলাম। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। হঠাৎ আমার মাথায় কী খেলে গেল। আমি আবার ফোন করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, হ্যাঁ রে, সুজয়ের সেই গাড়ির ব্যবসাটা এখনও আছে?

মৌমিতা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ আছে। তোর লাগবে?

আমি বললাম, না না, একটা কথা বল, কোনো সুমো আছে তোদের? ওটাতে কি ডুমুরদহের ওদিকে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?

ওদিকে মৌমিতার গলাটা চুপ। কিছুক্ষণ পর বলল, তুই জানলি কী করে? প্রশান্ত বলেছে? ওর কানেকশানেই সুজয় বেঁচে গেল…. সে অনেক গল্প….. বাই দ্য ওয়ে…. তুই সুজয়ের ফোনে ফোন করিস না। পাবি না। কারণটা বুঝতেই পারছিস। শ্লা কী করে নাম্বার পেয়ে মোটা টাকা চাইছে এখন। তুই আমাকেই কল করিস…..

আমি বললাম, আচ্ছা।

আলো নিভিয়ে শুতে গেলাম। ঘুম আসবে না জানি। আচমকা মনে হল, আমি সুজয়ের বাড়ির ভেতর থেকে একটা বাচ্চার আওয়াজ শুনেছিলাম। অবাক হয়েও ভেবেছিলাম, পাশের বাড়ির হবে।