যা ভাবা হয়েছিল তাই। গাছে একটাও কাঁঠাল নেই। মানে শুধু ছাল পড়ে আছে। একটা বীজও নেই। এবার বীজগুলো এদিকে ওদিকে পড়ে থাকবে। মানে বীজ হজম তো তেনারা করতে পারবেন না, কিন্তু ছড়াবেন।
নকুড়ের ঠাকুমা, উঠান ঝাঁট দিতে দিতে, এক হাতে আঁচল দিয়ে চোখ-নাকের জল মুছতে মুছতে বলল, এই পোড়া গ্রামে মানুষ থাকে? একটা কাঁঠালও গাছে রাখতে দেবে না গো! সব খাবে! আরে মানুষ হয়ে খেয়ে সাধ মেটেনি, ভূত হয়েও খাবি!
এইসব আরো কত কি বলে যাচ্ছে নকুড়ের ঠাকুমা। তবে কথাগুলো তো আর মিথ্যে নয়। এই সাড়ে বিয়াল্লিশ গ্রামে আজ অবধি একটা কাঁঠালও কোনো মানুষ পেয়েছে? না। গ্রামটার নামই এখন লোকে বলে কাঁঠালখেকো গ্রাম। তবে এটাও ঠিক তেনারা আর কোনো উৎপাত করে না। বরং ছোটোখাটো উপকারই করেছে তারা। এই যে নকুড়ের ঠাকুর্দা, একবার গাড়ু নিয়ে যেতে ভুলে গেল। তা মাঠে তো বসেছে। অমাবস্যা কেটে সবে একফালি চাঁদ আকাশে উঁকি দিয়েছে। নকুড়ের ঠাকুর্দার মনে পড়ল, এই যা! গাড়ু তো আনা হয়নি। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। এদিকে পুকুরও নেই কাছেপিঠে। হঠাৎ মনে হল পিঠের উপর কে জল ঢালছে। নকুড়ের ঠাকুর্দার ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিল তার পিঠে কেউ হিসি করে দিচ্ছেটিচ্ছে নাকি! কিন্তু এই ঘন জঙ্গলে কে এই অন্ধকারে আসবে তার পিঠে হিসি করতে। তো সে-ই বলল, নাও কাজ সারো… মাঠে এভাবে উদোম বসে থেকো না হেগেটেগে... এখনি আমার আত্মীয়রা এই রাস্তা দিয়ে আসবে, ওরা আবার কলকাতার ন্যাশেনাল লাইব্রেরির ভূত। ভীষণ শিক্ষিত। তোমায় এভাবে দেখলে ভালো হবে? নাও, নাও সারো, আমি জল ঢালছি। তো নকুড়ের ঠাকুর্দা সব সেরে ভালোভাবে ফিরেও এসেছিল।
এরকম অনেক ছোটো ছোটো ঘটনা আছে। পাঁচুর দিদির বিয়ের সময় পিঁড়ি ধরার লোক হচ্ছিল না। মোটে তিনজন। এদিকে পাঁচুর দিদির ওজন তো তখন চুরানব্বই কেজি। ওকি তিনজনের কাজ? তো তেনারাই এগিয়ে এসে কাজটা সেরে দিয়েছিল। সে কথা থাক। কথা হচ্ছে কাঁঠাল নিয়ে। কাঁঠাল একটাও গ্রামে রাখা যায় না। এমনকি হাটে যদি অন্যগ্রাম থেকে কেউ কাঁঠাল আনল, আর সন্ধ্যের মধ্যে ফিরতে না পারল, তো না বিক্রি হওয়া কাঁঠালের দফারফা। সব শেষ। আসলে কাঁঠালের দাম এত, সবাই তো আর কিনতে পারে না! তাই অগত্যা..
এই গ্রামের লোক বাইরের অন্যগ্রামে গিয়ে কাঁঠাল খেয়ে আসে। কোনো আত্মীয়ের বাড়ি কাঁঠাল ভাঙা হলে ডাক আসে। কারোর কারোর আবার তেনাদের উপর এতটাই মায়া যে তারা আবার কোঁচড়ে করে চারটে কোয়া নিয়ে আসে। এনে বারান্দায় রেখে দেয়, কি উঠানে। তেনারা এসে খেয়ে যান।
নকুড়ের ঠাকুর্দার এই যায় সেই যায় অবস্থা। ঘরে আত্মীয়স্বজন ভর্তি। ডাক্তার বলে গেছেন আর কিছু করার নেই। নকুড়ের ঠাকুমা কানের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কিছু খেতে সাধ যায়?
তিনি জড়ানো গলায় বললেন, এক কোয়া কাঁঠাল।
ব্যস..., ঘরে হইহই করে কান্নার রোল পড়ে গেল। শেষে কি দাদা, ঠাকুর্দা, বাবা, মেশো, পিশে, বাল্যবন্ধু… শেষ বাসনাটা না পুরিয়েই জগত ছেড়ে যাবে?
আচমকা ঘরে দমকা ঠাণ্ডা বাতাস এলো। নকুড়ের ঠাকুমার কোলের কাছে টুক্ করে এক কোয়া কাঁঠাল পড়ল। বীজ ছাড়ানো। নকুড়ের ঠাকুমা তাড়াতাড়ি সেটা মাথায় ঠেকিয়ে স্বামীর মুখে দিল, একটা কামড় দিয়েছে কি দেয়নি, ব্যস.. প্রাণবায়ু কাঁঠাল সরিয়ে বেরিয়ে গেল।
দুর্গাপুজো সামনে। চণ্ডীমণ্ডপে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবার মুখে মুখেই নকুড়ের ঠাকুর্দার ভূতের দেওয়া কাঁঠালের গল্প। তবে তো একটা আলোচনা সভা ডাকলেই হয়। একটা যদি রফা করা যায় যে সব কাঁঠাল ওরা খাবে না, গ্রামের মানুষের জন্যেও থাকবে। সেটা কেমন হয়?
সবাই রাজী হল। ঠিক হল সামনের অমাবস্যার দিন রাতে, বুড়ো শিবতলায় যে বটগাছটা আছে, তার নীচে আলোচনা সভা হবে। রাত দশটার পর। বাচ্চাদের সেদিন তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে।
সারা গ্রাম চারদিন ধরে মাইকে মাইকে ঘোষণা করে তেনাদের অনুরোধ জানানো হল। তেনাদের সবাইকে সেদিন উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানানো হল শুধু না, সেখানে পর্যাপ্ত কাঁঠালের ব্যবস্থাও থাকবে কথা দেওয়া হল। হাটের থেকে কেনা হবে।
সময় উপস্থিত। গ্রামের বহুলোক চাটাই পেতে বসে। সামনের চেয়ারে পঞ্চায়েতের সদস্যসহ প্রধান, উপপ্রধান। সঙ্গে কয়েকজন চিকিৎসক, উকিল আর থানার বড়বাবু।
কিন্তু তেনারা এসেছেন কি আসেননি বোঝা তো যাচ্ছে না! কি হবে?
প্রধান দু'বার গলা খাকারি দিয়ে বললেন, এই যে, আপনারা কি এসেছেন?… মানে আমরা কি আলোচনা শুরু করব?..
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মশার কামড়। জোনাকির টুপটুপ। দূরে শেয়াল ডাকার আওয়াজ। মাঝে মাঝে হাওয়ায় বটের পাতাগুলো মর্মর আওয়াজ করে উঠেছে। সবাই ফিসফিস করে বলে উঠছে, ওই এসেছে… কিন্তু না। আবার সব চুপচাপ।
হঠাৎ টুক্ করে একটা কাঁঠালের বীজ এসে পড়ল পঞ্চায়েত প্রধানের টাকে। তিনি ভীষণ ভালো মানুষ। চট করে রাগেন না। তিনি মোলায়েম গলায় বললেন, এসেছেন তবে? সুস্বাগতম!
হঠাৎ অন্ধকারে ভীষণ মিষ্টি গলায় একজন মহিলা বলে উঠলেন, আমিই ওদের মুখপাত্র। বলুন, কি বলবেন?
সবাই তাকিয়ে দেখে নকুড়ের বিধবা পিসিমা। ভূতেরা নাকি তাকেই মুখপাত্র বানিয়েছে।
হঠাৎ সে পিসি দশ হাত উঁচুতে উঠে সারা মাঠ ঘুরতে ঘুরতে বলল, কাঁঠাল খাবি? খা দেখি.. আমরা রাখলে তো খাবি? সে নবাবের আমল ছিল। আমাদের এক গাঁ লোককে কাঁঠালে বিষ মিশিয়ে মারল। আমরা সেই থেকে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মায় এদ্দিন হল কেউ আমাদের হয়ে কাশী গিয়ে পিণ্ডি অবধি দিয়ে আসার দরকার মনে করল না। এখন এসেছেন কাঁঠালের শোকে। মর মর….
তাই তো। এই কথাটা তো কারোরই মাথায় আসেনি। তো মিটিং-এ ঠিক হল গ্রামের সবাই যাবে কাশী। দেওয়া হবে পিণ্ডি।
সে আর কি বলা। গ্রামে কুকুর, বেড়াল, কাক, মুরগী ছাড়া সক্কলে গেল কাশী। ভূতেরা গ্রাম পাহারা দিল। পিণ্ডি দেওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই তো আর মুক্ত হওয়া যায় না। পনেরো দিন লাগে অ্যাপ্লিকেশান জমা দেওয়ার পর। তারপর এত পুরোনো কেস্। আরো নাকি সময় লাগতে পারে।
তো যা হোক। সব্বাই মিলে পিণ্ডি দিয়ে গ্রামে ফেরা হল। আশ্চর্য, একটা কাঁঠালেও কেউ হাত দিচ্ছে না। সবাই খুশী। কিন্তু আবার মন খারাপ। এদ্দিন ধরে সবার সঙ্গে থাকা তো। কাঁঠাল পাকলেও কেউ মুখে দিতে পারছে না। মনটা দুঃখ লাগছে। সবাই বারান্দায় কয়েক কোয়া করে রেখে আসছে। ওরাও খেয়ে যাচ্ছে। এই করে প্রায় দু'বছর হয়ে যাওয়ার পর সবাই ভাবল কি হল, ওদের তো এদ্দিন মুক্তি পেয়ে যাওয়ার কথা। পেল না কেন?
শেষে জানা গেল, ওই পিসির মুখেই তারা জানালো, এই যে মিলেমিশে সবাই এক সঙ্গে আছে, এর থেকে কি আর স্বর্গ ভালো?
তো এখন যদি তুমি এই সাড়ে বিয়াল্লিশ গ্রামে আসো। দেখবে, হাওয়ায় হয়তো কোনো বাচ্চা দোল খাচ্ছে, কি ছাদের উপর মেলা চাদর, পট পট বড়ি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে, কি মাঠে গরু নেই, কিন্তু লাঙল দিয়ে চাষ হয়ে যাচ্ছে। সব তেনাদের আর এনাদের যৌথ অভিযান। মানে সংসার আর কি।
(ছবি: Suman)