Skip to main content


==

চেনা ফুলের গন্ধ। তবু ছেড়ে যেতে হবে। গন্ধের চেয়ে আপন কোনো স্মৃতি নেই। পোড়া উনুনের গন্ধ, ভিজে মাটির গন্ধ, মাথার তেলের গন্ধ, তেত্রিশটা বছর সঙ্গে কাটানো মানুষটার ঘামের গন্ধ, এই রেললাইনের গন্ধ... সব চেনা মৈত্রী রেড্ডি'র। বয়েস ষাটই হবে। স্পষ্ট মনে নেই। 

    ছোটো স্টেশান। ভোরের আলো অল্প অল্প কিশোরত্ব পাচ্ছে। ট্রেন দেরি আছে। কেউ ছাড়তে আসেনি। আসবেও না। মৈত্রী বাণপ্রস্থে যাচ্ছে। সংসারে সব আছে। কিন্তু মৈত্রী আর সংসারে থাকবে না। শেষ কয়েক বছর নিজেকে মাকড়সার মত লাগছিল। নিজের জালে নিজে আটকে গেছে যেন সে। মৈত্রী অরুণাচলমে যাচ্ছে। রমণ মহর্ষির আশ্রমে।

    মৈত্রী'র বাবা রমণ মহর্ষির আশ্রমে যেতেন। মহর্ষিকে একবার দেখেছে মৈত্রী। তখন কত ছোটো সে। তবু চোখদুটো স্পষ্ট মনে আছে। সারা জীবন ধ্রুবতারার মত তার সঙ্গে সঙ্গে চলল। কয়েকবার সে চোখ মেঘে ঢাকেনি তা নয়। তবু আবার মেঘ কেটেছে। তার স্বামী কার্তিকেয় মারা যাওয়ার পর ভাইয়েরা এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে। মৈত্রী যায়নি। কিসের জোরে যায়নি? ওই চোখদুটোর জোরে। একা বরের দোকান সামলেছে। বিজাওয়াড়া গিয়ে মাল এনেছে একা। অতবড় শহরে হারিয়ে যায়নি। আসলে মৈত্রী ছোটোবেলা থেকেই জানত সে হারিয়ে যাবে না। রমণ মহর্ষি'র চোখের আশ্রয় তার সঙ্গী। তার গুরুদেব। কোনো দীক্ষামন্ত্র নেই। ঈশ্বর সংস্কৃত ছাড়া কি অন্য ভাষা বোঝে না? পশুপাখির কথাও কি তিনি বোঝেন না? তবে আর সংস্কৃতে একটা শব্দমালা আবৃত্তি করে কি হবে অনর্থক কেবল। আসল তো নিজেকে খুঁজে নেওয়া। 

    নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে কি গভীর আনন্দ! নিজেই নিজের আনন্দ মৈত্রী। সারাদিন সে মনে মনে নিজেকে খুঁজেছে। কে সে? কার্তিকেয়'র সংসারে যেদিন বউ হয়ে ঢুকল, সেদিন সে বুঝেছিল একটা সুড়ঙ্গে ঢুকেছে। অনেক মানুষ নিয়ে বড় পরিবার। তার স্বামী বড়। আয়ের থেকে ব্যয় ছিল বেশি। সঙ্গে নানা অভিযোগ। অন্যায় অভিযোগ। হাতের কাছে মৈত্রী ছিল তাদের যাঁতার মত। সারাদিন পিষে ফেলার চেষ্টা হত। মৈত্রী আঘাত পেলে নিজেকে জিজ্ঞাসা করত, কে পেল আঘাত? মৈত্রী আনন্দের মুহূর্তে নিজেকে জিজ্ঞাসা করত, কে পেল আনন্দ? কার্তিকেয়'র অভিযোগ ছিল মৈত্রীর মধ্যে কেন উচ্ছ্বাস এত কম। কিন্তু কোনো অভিযোগের জায়গা কি সত্যিই রেখেছে মৈত্রী কার্তিকেয়'র জীবনে? তার দোকানের হিসাব থেকে তার শরীর মনের পরিচর্যায় কোনো ত্রুটি রেখেছে? রাখেনি। হয় তো সবটা সম্পূর্ণভাবে পারেনি। কিন্তু পেরেছে তো অনেকটাই। অথচ কার্তিকেয় কতটা তাকে জানত? জানত যে মৈত্রী কবিতা লেখে? জানত যে শেষরাতে সে ধ্যানে বসে? জানত যে স্নানের সময় সে কারোর প্রশ্নের উত্তর দিতে পছন্দ করে না? জানত যে সে খাওয়ার পর একটু মিষ্টি খেতে ভালোবাসে? জানত যে সে অরুণাচলমে রমণাশ্রমে যেতে চায়? না, কিচ্ছু জানত না। এটাই নিয়ম। মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা তাদের মর্জির উপর সে পুরুষেরা জানে। আসলে পুরুষেরা না, একটা সমাজ, মৈত্রী জানে। একটা সমাজ দীর্ঘদিন ধরে একভাবে চলে চলে অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছে। মানুষ নিজে যে অভ্যাস গড়ে তুলেছে সচেতনভাবে তাকে সে ভাঙতে পারে। কিন্তু মানুষ নিজে যে অভ্যাসের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, সে অভ্যাস তার অচেতনে কখন যে তাকে পেয়ে বসেছে সে বোঝে না। যখন বোঝে তখন তার থেকে বেরোতে ভয় পায়। কারণ সে অভ্যাসগুলোর সঙ্গে আত্মপরিচয় জড়িয়ে গেছে। তাদের ছাড়লে সে নিজে দাঁড়াবে কোথায়?

    সাইড লোয়ার বার্থ মৈত্রী'র। ট্রেন ছাড়ল। সংসার ছাড়ল। স্টেশানটা পেরিয়ে যাচ্ছে। ওই যে রাস্তাটা বেঁকে একটা শিমূল গাছের পাশ দিয়ে শিব মন্দির হয়ে পুবের দিকে গেছে, ওদিকে চার কিলোমিটার হাঁটলেই তার বাড়ি। চড়া রোদ উঠে গেছে। এখন বাড়িতে থাকলে সে খবরের কাগজ নিয়ে বসত। নাতি দোকানে বসে এখন। নাতির মুখটা মনে বিঁধল ব্যথা হয়ে। মৈত্রী সামনের কুপের দিকে তাকালো। বড় পরিবার। ছ'টা সিট জুড়েই তারা। খাওয়া-দাওয়া করছে। গুজরাটি মনে হল। মৈত্রী ব্যথাটাকে বাড়তে দিতে চায় না। ফোনটা এখনও সুইচ অফ্ করা আছে। বুকটায় মোচড় দিচ্ছে। এত কেন? মৈত্রী'র চাওয়া পরোয়া না করেই চোখের কোল ভর্তি হয়ে এল জলে। মৈত্রী চোখটা বন্ধ করে পা টানটান করে নিজেকে জিজ্ঞাসা করল, কে কষ্ট পাচ্ছে, কে ফিরে যেতে চাইছে? কে দোলাচাল অনুভব করছে? কে সংশয়কে জানে? কে সমস্তকে জানে কিন্তু বিচার করে না? কে তার এত বড় জীবনের সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের সাক্ষী? কে তার ঘুমের মধ্যে থাকে জেগে? কে তার জাগার মধ্যে থাকে সব চিন্তা অনুভবের পিছনে নিঃশব্দে?

    মৈত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ট্রেনের স্পিড অনেক। সব ছেড়ে যাচ্ছে পিছনে। সব ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কে সে অন্তরে সে সব ছেড়ে গেলেও যে ছেড়ে যায় না! সব ছেড়ে যাওয়ার যে সাক্ষী সে কে?

    মৈত্রী দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে। তার সমস্ত ফেলে আসা জীবনটা মনের পর্দায় ছোটো ছোটো বিন্দু হয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। কোনো ছবি স্পষ্ট নয়, তবু তাদের অস্তিত্ব স্পষ্ট। এতবড় সংসারে, এ অসীম কালের স্রোতে একটা বিন্দু সে। তার স্মৃতি সে বিন্দুর মধ্যে আরেকটা বিন্দু। তার গোটা জীবনটা বাইরে তো কোথাও নেই আর, শুধু তার স্মৃতিতেই আটকে আছে সে। এত বড় সংসারে তার শোক-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়াই কি শেষ কথা? মন জাল তোল, জাল তোল, মৈত্রী নিজেকে বলল। সে কোনো স্মৃতিকে কাছে এনে হাতে নিয়ে দেখল না, আবার কোনো স্মৃতিকে দূরে ঠেলেও ফেলতে চাইল না। ওদের জীবনের সঙ্গে মৈত্রীর জীবনের আর কোনো যোগ নেই। ওদের দিকে তাকালেই ওরা তার মুখের দিকে তাকাবে। ওরা মিলিয়ে যাক। 



===

আশ্রমে তার জন্য যে ঘর, সে ঘরটা খুব বড় না। মৈত্রী নিজেই চায়নি বড় ঘর। চিরকাল ছোটো ঘরে থেকে এসেছে, এই ভালো। 

    প্রথম চারদিন এক ঘোরে কাটল। মন্দিরে যায়, ধ্যানে বসে। বাকি সময়টা কিছুটা রান্নাঘরে যায়, কোনো কাজ থাকলে করে দেয়। বই পড়ে। সারাদিন মনের মধ্যে এক ঝুমঝুম শব্দ। আনন্দ নয়। এক উত্তেজনা।

    ক্রমশ মনের মধ্যে একটা আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস যেন। ঠিক মন না। মনের গভীরে যে চেতনা, সে মনের থেকে মুখ ফিরিয়েছে যেন। মন ঘোলা হচ্ছে। দিনে দিনে আরো ঘোলা হচ্ছে। সেই চোখটাই বা কোথায়? এদিকে ওদিকে রমণ মহর্ষি'র ছবি তো আছে। সেই চোখ। কিন্তু সে চোখে কি যেন পড়তে পারছে না মৈত্রী। স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে না। নিজের ছোটোবেলার স্মৃতিকে জাগাতে চাইল। জাগল না। সংসারে ছোটো-বড় কত আঘাতের কথা মনে করল। মন অভিমানী হল। ঠোঁট ফোলালো। কিন্তু চিত্তে কোনো সাড়া দিল না। মাথার মধ্যে সারাদিন এক ঝুমঝুম শব্দ। আনন্দ নয়। বিষাদ নয়। বিভ্রান্তি। 

    হঠাৎ একদিন খুব বৃষ্টি শুরু হল। সকাল থেকে বৃষ্টি। মৈত্রী রমণ মহর্ষি'র ছবির সামনে বসে। দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে। 

    মৈত্রী নিজেকে জিজ্ঞাসা করল, আমি এখানে কেন?

    চোখ নীরব। 

    মৈত্রী বলল, আমি আশ্রমের জীবন চাই। সংসার আর ভালো লাগে না। আমি সবার থেকে একা হতে চাই। আমি একা। 

    চোখ নীরব।

    মৈত্রী বলল, আমি এবারে আমার মত করে আনন্দ চাই। আমার একান্তের আনন্দ। আমার আত্মাকে আমি মুক্ত করে সেই মুক্তির আনন্দে নিমগ্ন থাকতে চাই। 

    চোখ নীরব। 

    মৈত্রী বাইরের দিকে তাকালো। তার বাড়ির সামনের করবীগাছটার কথা মনে পড়ছে। করবী ফুলের গন্ধ তাকে যেন ডাকল, আয়। 

    মৈত্রী বলল, কিন্তু কি যেন হচ্ছে না। আমি কি ভুল করলাম? আমি কি এখানে থাকার যোগ্য নই? আমি কি প্রস্তুত নই?

    চোখ নীরব। 

    মৈত্রী বলল, তুমি কি চাও না তবে আমায়? তাই দূরত্ব?

    চোখ বলল, দূর আর কাছে মনের ভাবনা। শরীরের মাপে। ঘুমের মধ্যে বোঝো তুমি কোথায়? কোন দেশে?

    মৈত্রী বলল, না। 

    চোখ নীরব।

    মৈত্রী বলল, তবে কি আমি আসতে চাইনি?

    চোখ বলল, পালাতে চেয়েছ। তাই এত আয়োজন। যে আসে সে নিজের অজান্তেই এসে পড়ে। বিনা আয়োজনে। 

    আমি তবে ফিরে যাব? মৈত্রী জানা উত্তরের প্রশ্ন করল। 

    চোখ নীরব।

    আসা যাওয়া তো বাইরের। ভিতরে কি আসা যাওয়া আছে? কার্তিকেয় কি সত্যিই কোথাও গেছে?

    ট্রেন যখন স্টেশানে এলো তখন ভোরের মত বিকালের আলো। মৈত্রী হাঁটতে শুরু করল। ফোন সুইচ অন্ করা হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে শিবমন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মৈত্রীর এই প্রথম মনে হচ্ছে সে যেন প্রথম সবটা নিয়ে এসে দাঁড়ালো এই মূহুর্তে। তার ভবিষ্যতের কোনো অপেক্ষা নেই। যা আছে এখনই আছে। সব নিয়ে এই তো আছে। সুখ দুঃখ যেমন আছে, সে সবের সাক্ষী এক মহাচেতনাও এই মুহূর্তে তাকে ঘিরে আছে। নইলে এত বড় জীবনের ভার সে একা বয়ে বেড়াতে পারে? এত ক্ষমতা তার? শুধু কার্তিকেয় না, সে-ও এক চিন্তার অভ্যাসে নিজেকে অবশ করে ছেড়ে রেখেছিল। তাই এমন দূর আর কাছের, বাঁধন আর মুক্তির ইচ্ছা ফেঁদেছিল। নিজেকেই ঠকিয়েছে। কি পায়নি সে জীবনে? সব পেয়েছে। একটা গোটা জীবনকে সে পেয়েছে। আর কি চাই? কিচ্ছু না। 

    মৈত্রী বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। করবী গাছটা ফুলে ভর্তি। তার মনে হল সে যেন অরুণাচলমের মন্দিরের গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে। প্রতিটা ফুলে যেন সেই চোখের জ্যোতি। সেই চোখের করুণা। সেই চোখের আশ্রয়। কোথায় যেতে চেয়েছিল সে?