Skip to main content
 
কান্তাচার্য্য ঠান্ডা মাথার মানুষ। সবাই জানে। কিন্তু সেদিনের কান্ড দেখে সবার আক্কেল গুড়ুম। এত রাগতেও পারে কান্তা! 
 
     ঘটনাটা খুলেই বলি। কান্তাবাবুদের বাড়ির পাশেই থাকেন চক্কোতি বাবু। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে বিশাল সংসার। কিন্তু চক্কোতি মশায়ের মেজাজটা বড় উচ্চগ্রামে বাঁধা। কদাচিৎ তাঁর কন্ঠে কেউ মধ্যম বা মন্দ্র সপ্তক শুনতে পান।
     সে যা হোক। ঘটনাটার সূত্রপাত হল পুঁটিকে নিয়ে। আরে পুঁটি গো, মানে কান্তাবাবুদের পোষ্য বেড়াল। সে বেটি বাচ্চা বিয়োবার আর জায়গা পেলো না। তিন তিন খান ফুটফুটে সাদা বাচ্চা চক্কোতি মশায়দের রান্নাঘরের কোণে জন্ম দিল। প্রথম কদিন কেউ টের পায়নি। কান্তাবাবুর গিন্নী অবিশ্যি মাঝে পুঁটির খোঁজ কয়েকবার করছিলেন। কিন্তু বিড়াল হারালে তো আর পুলিশে রিপোর্ট লেখে না, তাই চুপ করেই ছিলেন। 
     ওদিকে কয়েকদিনের মধ্যেই পুঁটির বংশবৃদ্ধির খবরটা জানাজানি হয়ে গেল। চক্কোতি মশায় কংস রূপ ধারণ করলেন আর তিনটে বাচ্চাকেই স্বধামে পাঠিয়ে ক্ষান্ত হলেন। চক্কোতি গিন্নী বার কয়েক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন "ওগো শোনো। ওরা মা ষষ্ঠীর বাহন, এরকম কোরো না। আমি বরং তারা বৌদিকে (কান্তাবাবুর স্ত্রী) বলি, সে এসে নিয়ে যাবেখন।" তা কে কার কথা শোনে। ষষ্ঠীর বাহনদের গুষ্ঠি নাশ করেই ছাড়লেন চক্কোতিবাবু। 
     এ খবর কান্তাবাবুদের কানে গেল। ব্যস। রোববারের সকাল। লেগে গেল নারদ নারদ। তবে মাইরি বলছি, কান্তাবাবুর এ রূপ আমিও কোনদিন দেখিনি। প্রায় হাতাহাতি হয়ে যায় আর কি! পাড়ার ছেলেরা, পটলা, তারাদেবী মায় কাজের মাসি পর্যন্ত রণক্ষেত্রে নেমে কান্তাবাবুকে ঘরে আনলেন। ওদিকে চক্কোতি মশায়ের ছেলেরা, নাতিরা, জামায়েরা এমনকি বড় ছেলের শ্বসুর অবধি টানাটানি করে তাঁকে মানে চক্কোতি মশায়কে ঘরে নিয়ে গেলেন। কেউ যদি দূর থেকে দেখে থাকেন, শব্দগুলো কানে না গেলে মনে হবে দু'পক্ষের বুঝি অদৃশ্য দড়ি নিয়ে টাগ অফ ওয়ার খেলা হচ্ছিল। 
     কান্তা ঘরে ফিরে সকাল থেকে কিছু খেলেন না। তাঁর যে মূর্তি তারাদেবী দেখেছেন, তাতে তাঁর নিজেরও আর সাহসে কুলাচ্ছে না ওঁকে খাওয়ার কথা বলতে। তিনি পটলাকেই শুধু দুগ্রাস খাইয়ে দিলেন। সে বেচারাও খুব ভড়কে গেছে, বাবার এত রাগ সে বাপের জন্মে দেখেনি! 
     কান্তা সারারাত ঘুমোতে পারলেন না। না, রাগে না। রাগ তাঁর পড়ে গেছে সন্ধ্যের পর থেকেই। এখন কেমন একটা অনুশোচনা হচ্ছে। চক্কোতি মশায় না হয় ভুল করেইছেন, তা বলে তিনি নিজে যা করতে যাচ্ছিলেন তাই বা কম কি? ছি: ছি:। একেবারে গায়ে হাত তুলতে যাওয়া! ভাগ্যিস পাড়ার ছেলেগুলো ঠেকিয়েছিল, না হলে তো রক্তারক্তি কান্ড হতে পারত! ছি: ছি: ছি:! 
     ভোর ভোর উঠলেন। মনটা খচখচ করেই যাচ্ছে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন হাঁটতে। বেরোবার সময় একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন চক্কোতি বাড়ির কেউ উঠেছে কি না। না, কেউ ওঠেনি। কি লজ্জা! যা হোক মনটা তবু বিষন্ন। চক্কোতি মশায়ের কাজটাও কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। পুঁটির মুখটা মনে পড়লেই তাঁর রাগ, কষ্ট মিলে কিরকম করে উঠছে বুকের মাঝখানটা। তিনি না পারছেন নিজেকে ক্ষমা করতে, না পারছেন চক্কোতি মশায়কে ক্ষমা করতে। কি যন্ত্রণা! 
     কান্তাবাবু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছেন। এমন সময় কানের পাশেই "বল হরি...হরি বোল", শুনে কান্তাবাবু চমকে তাকালেন। তাঁর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে শববাহী শ্মশান যাত্রীর দল। শ্মশান যাত্রীদের কান্তাবাবু আলাদা করতে পারেন না। মনে হয় সব এক। এবারও তাই হল। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। খোলের আওয়াজ, কান্নার আওয়াজ, হরি-ধ্বনিতে পুঁটি, চক্কোতি, তিনি নিজে - সব ভেসে গেল।
 
 
     কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর মনে নেই। কিন্ত হঠাৎ তিনি হনহন করে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বাড়ি গেলেন। টাকার ব্যাগ নিলেন। আবার হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন।
 
     শ্মশানে যখন পৌঁছলেন তখন তিনি যাকে বলে এক্কেবারে গলদঘর্ম অবস্থায়। একটা কোণে চুপ করে বসলেন। দাহকাজ শেষ হল। তারা চলে গেল। এখন শ্মশানঘাট ফাঁকা। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শ্মশানের অফিস ঘরের দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললেন, "আসব?" 
     একজন আনুমানিক বয়স তিরিশের ছেলে খাতায় ঝুঁকে কি লিখছিল। মুখ না তুলেই বলল, "আসুন, বসুন।" 
     কান্তাবাবু ঢুকলেন। বসলেন। 
     ছেলেটি মুখ তুলে বলল, "বলুন?" 
     কান্তাবাবু হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, "আমি কান্তাচার্য্য, মিত্তিরপাড়ায় থাকি।" 
ছেলেটিও প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলল, "আমি নিমাই। বলুন কি সাহায্য করতে পারি?"
     ইতিমধ্যে একজন বুড়িকে দাহ করতে একদল এসে গেছে হইচই করতে করতে। কান্তাবাবুর মনে হচ্ছে যেন চড়ুইভাতি করতে এসেছে, মনটা আবার বিগড়ে যাচ্ছিল। যা হোক কথায় ছেদ পড়ল। নিমাই তার কাজ সেরে আবার কান্তাবাবুর দিকে ঘুরে বললেন, "বলুন।"
     কান্তাবাবু কিছুটা আমতা আমতা করে নিমাই-এর হাত দু'খানি ধরে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন বললেন, "একটা উপকার তোমায় করতেই হবে বাবা। 'না' বললে চলবে না।"
     নিমাই তো একেবারে হাঁ। শ্মশানে কান্নাটা নতুন কিছু না। কিন্তু এভাবে বিনা ভুমিকায়! লোকটাকে দেখে তো পাগল মনে হচ্ছে না।
     সে খাবি খেয়ে, ঢোক গিলে বলল, "আচ্ছা বলুন না। তারপর দেখছি।" 
কান্তাবাবু বললেন, "দেখছি না বাবা। এটা তোমায় করে দিতেই হবে।" 
     "আচ্ছা বেশ, কি বলবেন তো?" 
কান্তাবাবু তার হাতদুটো ধরে আরো কাছে এসে বললেন, "আমাকে দাহ করার টাকাটা তোমায় এখনি নিতে হবে বাবা, আজই, অগ্রিম। আর একটা রসিদ কেটে দিতে হবে।"
     নিমাই-এর মুখটা কেমন দেখাচ্ছিল আমি বলে বোঝাতে পারব না। তবে তার মনে হচ্ছিল তার সামনে খাটে শোয়ানো ঠাকুমাও যেন নড়ে উঠলেন মানুষটার কথা শুনে। 
     সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "তা হয় না কাকাবাবু। জ্যান্ত লোকের টাকা আমি কোন রসিদে কাটব?" এরপর অনেক অনুরোধ, উপরোধ। কিন্তু কাজ কিছুতেই হল না।   
     কান্তাবাবু অবিশ্যি জানতেন এ সহজ কাজ না। তাই গিন্নীকেও বলে এসেছেন যে তাঁর ফিরতে দেরি হবে, আজ অফিস যাবেন না। বাড়ির কেউ যেন দুপুরে তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে। খেয়ে নেয়।
     যা হোক, এদিকে ফ্যায়সলা হল, কান্তাবাবুকে মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান অধীর বাবুর সাথে দেখা করতে হবে। অগত্যা। তিনি একটা দোকানে চা, বিস্কুট খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন মিউনিসিপালিটির সামনে।  
     সাড়ে এগারোটা নাগাদ চেয়ারম্যান আসলেন। শুনলেন। প্রথমটা কাঁদবেন না হাসবেন, উনি ঠাট্টা করছেন কিনা, বিরোধী পার্টি কোনো চাল চালছে কি না... এরকম সম্ভাব্য অসম্ভাব্য অনেক চিন্তা করলেন। কিন্তু কোনোটাই ধোপে টিকল না। এমন কি ভদ্রলোক (না উন্মাদলোক ?) অনশনের ভয় অবধি দেখিয়েছেন। সামনে ভোট। তাই এত রিস্ক নেওয়া যাবে না। কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায় কে বলতে পারে। অগত্যা উনি কান্তাবাবুকে বিকাল চারটেতে আসতে বলে বিশেষ মিটিং ডাকলেন। 
     মিটিং-এর সবিস্তার বর্ণনা দিতে যাব না। তাতে আরেকটা গল্প হয়ে দাঁড়াবে। শুধু এতটা বলতে পারি, মিটিং-এ সবার বিষম লাগা সামলাতে মিটিং চলাকালীন দু'বার বিরতি ডাকতে হয় চেয়ারম্যানকে।
     বিকাল ঠিক চারটের সময় কান্তাবাবু হাজির। বাড়ি যান নি। শ্মশানেই বসেছিলেন। সামনের দোকান থেকে দুপুরে ভাত খেয়ে নিয়েছেন। 
     "শুনুন কান্তাবাবু, এ ধরণের অনুরোধ তো আগে আসে নি। তাই আমরা খুবই কনফিউজড ব্যাপারটা নিয়ে। আমরা ঠিক করেছি একটা সাদা কাগজে আপনার বয়ান নিয়ে, সই নিয়ে একটা কাঁচা রসিদ দেব। তারপর উপর তলায় চিঠি লিখে দেখব এরকম কোনো নিয়ম বানানো যায় কি না। বুঝলেন?" 
     কান্তাবাবু মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে শুনছিলেন। চেয়ারম্যান এর কথা শেষ হতেই খপ করে ওনার হাত দুটো ধরে খুব করে, গদগদ স্বরে নিজের কৃতজ্ঞতা জানালেন। তারপর কথা অনুযায়ী কাজ হল। আশেপাশে লোকজন দেখে গেল উঁকি মেরে। কাজ পুরো হলে, রসিদ নিয়ে অধীর বাবু কান্তাবাবুর হাতে দিলেন।
     তারপর চেয়ারম্যান বললেন, "আপনাকে একটা প্রশ্ন করব? যদি কিছু মনে না করেন।" 
     "বলুন না?" প্রসন্ন মুখে কান্তাবাবু চাইলেন চেয়ারম্যান এর দিকে। 
     "আপনার কি রোগ? মানে বলছিলাম সাউথে তো চিকিৎসার খুব উন্নতি এখন। তা সে দিকে কি গিয়েছিলেন একবারও?" কান্তাবাবু হাসলেন।
     "না চেয়ারম্যান সাহেব। আমার শরীরে কোনো রোগ নেই। রোগ আমার মনে। 'আমি' রোগ। ঠাকুর বলতেন না 'আমি ও আমার', এ সে রোগ মশায়। সহজে ছাড়বে কেন? ঠাকুর আরো বলতেন 'আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল'। এই জঞ্জাল থেকেই এত লোভ, ক্ষোভ, মারো, কাটো চেয়ারম্যান সাহেব। আমি ভাবলাম এই যে এত রাগ, ক্ষোভ, লোভ, অভিমান আমাদের, কিসে যায়? দেখলাম মশায় দেখলাম - মৃত্যুর মুখোমুখি হলে যায়। এই রসিদ, রাখলাম আমার ওয়ালেটে। যেই বাবু মাথাটি তুলবেন অমনি আমি একে ওর নাকের ডগায় ধরব। সে সুড়ুৎ করে তার গর্তে ঢুকে যাবে। আমি জানি সে বেটা যত হম্বিতম্বিই করুক না কেন, ভারী ভীতু সে। এখন আর আমায় পায় কে?" বলতে বলতে কান্তাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। "চলি", বলে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। গুন গুন করে গাইছেন.. 'ওরে আগুন আমার ভাই আমি তোমারি জয় গাই'। চেয়ারম্যান সাহেবের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। তিনি টেবিলের বেল চেপে চাপরাশিকে ডাকলেন। বললেন, "গাড়ি বার করতে বলো। শ্মশানটা একবার দেখে আসি। অনেকদিন যাওয়া হয় না।"