সময়, মানুষ আর সমাজ। এই তিনটের বুনটে একটা উপন্যাস গড়ে ওঠে। মানুষের দুই জগত, তার ভিতরের আর বাইরের। এই দুইয়ের মধ্যেই সংঘর্ষ আছে যদি বলি, তবে পুরো কথাটা বলা হয়ে ওঠে না। মানুষের আসল সংঘর্ষ তার ভিতরে। পশুর সমাজ বলে কিছু নেই, থাকলেও তার বাহ্যজগতের মধ্যে সীমায়িত, যা ইন্দ্রিয়জগতের বাইরে যায় না। মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মার চিরকালের টানাপোড়েন। নিজের বানানো নিয়মে, নিজের বিশ্বাসের কারাগারে, নিজের সংস্কারের প্রাচীরে সে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, ছায়ার সাথে লড়াই করে, কোনো একটা সময়কে স্থির জেনে সেই সময়ের মধ্যেই সমাজের যাবতীয় ধারাকে রুদ্ধ করে ফেলতে চায়। বাধে লড়াই, নতুনের সাথে পুরাতনের। গতির সাথে স্থবিরতার।
লেখক মণিশঙ্করের এই লেখাটা বাইরে দিক থেকে দেখলে বাজুনিয়া ডোম সম্প্রদায়ের একটা উপাখ্যান, না উপকথা?
নিজেকে ছেড়ে অন্যের দিকে তাকানোর মানুষের দুটি উপায় আছে – এক নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকানো, অবশ্য কোমল দৃষ্টিতে, যাকে সহানুভূতি বলে; অপরটি তার জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে তার দৃষ্টিতে অবস্থাটাকে দেখার চেষ্টা করা, ইংরাজিতে যাকে ইমপ্যাথি বা সহমর্মিতা বলে। মণিশঙ্কর এই দ্বিতীয় দলের। তিনি সহযাত্রী ঘটনা পরম্পরার। নিজেকে স্থির কোনো একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখছেন না। চলতে চলতে দেখছেন। ফলে দেখার মধ্যে গতি আছে, বেদনা আছে, দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু কোথাও শৌখিনতা নেই। গল্প কালুডোমকে ঘিরে, তার জন্ম ও তার পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে। কোথাও যেন একটা আবর্ত সৃষ্টি করে শেষে এসে। প্রকৃতির রুক্ষতা, শুষ্কতা, ভীষণতা – সমস্তই আবহ তৈরি করে। তবে সব চাইতে তীক্ষ্ণ যেদিকটা, সেটা হল লেখকের শব্দচয়ন। সেইখানের কথা বলার রীতির সাথে আমাদের কথা বলার মিল ঘটেছে এত স্বাভাবিকভাবে মনে হয় যেন দুই নদীর খুব স্বাভাবিক প্রাকৃতিক মিলনস্থলে এসে দাঁড়িয়েছি।
বইটা পড়ার অনুরোধ রইল। কিছু নতুন মানুষের সাথে নয় শুধু, একটা অন্যরকম সভ্যতার সাথেও যেন পরিচয় হবে। উপকথা, সামাজিক কথা, সেকালের কথা, একালের কথা মিলেমিশে শেষে মানুষের কথা হয়েই আপনার হাত ধরবে, বেড়াতে নিয়ে যাবে। একটু ঘুরেই না হয় আসা যাক।
বই – কালু ডোমের উপাখ্যান
প্রকাশক – কবিতা আশ্রম
মূল্য – ৪৫০/-
পাতা – ২৫২