রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানে অনেকের সৃষ্টিতে অনেকভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। নিন্দুকে মুখ বাঁকিয়ে বলে, অনেক ন্যাকানেকিও উনি তৈরি করে চলেছেন আজও। আমি সে বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু দুদিন আগের একটা ঘটনা বলি।
ভাদ্রের আকাশে শ্রাবণের মেঘ চরে বেড়াচ্ছে, এমন একটা দুপুরে হাজির হয়েছিলাম বাঁশবেড়িয়ার একটা অল্পশ্রুত মন্দির প্রাঙ্গণে। বেশ ফাঁকা ফাঁকা চারদিক। গঙ্গার সজল বাতাস ফুরফুর করে বইছে। মা জগদম্বা জগৎপিতার বুকের উপর দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে ভক্তের দিকে তাকিয়ে। জগত পিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে। অরসিক বলবে, নেমে যাওয়ার অপেক্ষায়, ভক্ত বলবে, এ এক লীলা।
আমি ওসব কিছু না ভেবেই মাকে জোড়হাতে প্রণাম করতে করতে শুনতে পেলাম… এইদিকে…. এইদিকে আয়… দারুণ হবে।
জগদম্বার থেকে চোখ কানকে অনুসরণ করল। কান শব্দের উৎসকে অনুসরণ করে বাইকে আগত ও আগতা দুই জোড়া তরুণ তরুণীকে আবিস্কার করল।
চারজনে বাইক থেকে নেমে মন্দিরের অন্যদিকে ফাঁকা জায়গায় এগিয়ে গেল। দুজন তরুণীই সাদা লালপেড়ে শাড়ি পরা, দুজন পুরুষ জিন্স আর টিশার্ট।
এ মন্দির চত্বরে বেশ কিছুটা সময় কাটাবো বলেই আসা, আর এই দুপুরে যাবই বা কোথায়। কিন্তু আসন্ন একটা বিপদের আঁচ তো পেলাম। যে বয়সে পৌঁছিয়েছি সে বয়সে তরুণীর সঙ্গে মেঘদূতের সম্পর্ক আর নেই, এখন শঙ্করাচার্যের মোহমুদগর কিম্বা ভতৃহরির বৈরাগ্যশতকমের যোগ। একটু দূরেই বসলাম। মানে মন্দির চত্ত্বরে যতটা জায়গা পাওয়া যায় দূরত্বের জন্য।
তারপর শুরু হল রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা তো কোন ছাড়, যাকে বলে পারমানবিক প্রেরণা। একজন তরুণী যিনি পোজ দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, তিনি সাদা লালপেড়ে শাড়ির আঁচলটা যখন সরালেন, বুঝলাম এ দৃশ্য গ্রামেগঞ্জে দেখেছি, ওনারাও অনেকে ব্লাউজ পরেন না, ইনিও পরেননি। যদিও কোথাও একটা এ দুটো তো আলাদাই। তারপর তিনি পোজ দিলেন। ক্যামেরা চালক পুরুষ বলল, আঁচলটা উড়িয় দে…
সব্বোনাশ! বলে কী! অন্যদিকে চোখ ঘোরালাম। এ দৃশ্য যখন ফাইনালি দর্শকের কাছে যাবে তখন না হয় দর্শক এডিটেড ভার্সানে দেখবেন, কিন্তু আমি? কী দেখতে কী দেখে ফেলব! থাক! গঙ্গার দিকে মুখ করে বসলাম। রবীন্দ্রনাথের অসহায় গান কানে আসতে লাগল। নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি…..
হঠাৎ সব শান্ত। কী হল? বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। যদ্দূর শক্তিশালী ও মুক্তমনা তথা মুক্তবসনা রিল তৈরি হচ্ছে, তার বেশি কিছু শুরু হয়নি তো?
ঘুরে তাকালাম আতঙ্কে! না। এক পক্ষের রিল বানানো হয়েছে। আরেকপক্ষের শুরু। সেই দ্বিতীয় তরুণী শিবের মন্দিরে এলিয়ে পড়ে একটা আলতা মাখা পা গঙ্গার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। সে পা ধরে দাঁড়িয়ে তার প্রেমিক! হাতে ধরা বই! কী বই? পরে দেখেছিলাম, বিভূতিভূষণের “আরণ্যক”। এর মানে কী? পুরাণের সে গল্প মনে পড়ল। মহাদেবের ধ্যান না ভাঙালে অসুরবধ হবে না। তাই মদনকে পাঠানো হয়েছিল। মদন চারদিকে বসন্ত এনে মহাদেবের বুকে মেরেছিলেন কামবাণ। ব্যস, চোখ খুলেই মহাদেব করে দিলেন ভস্ম। তারপর মদনের স্ত্রী রতির কান্নাকাটিতে মদনকে ক্ষমা করে বললেন, মানুষের হৃদয়েই থাকো অনঙ্গ হয়ে। এ কী রূপক তবে? এই সরস্বতীর সাধক পুরুষকে, রমণী তার মোহজালে পাঠ থেকে সরিয়ে চরণদাস বানিয়ে ছেড়েছে? এটা কি ফেমিনিজিমের নতুন কোনো দিক?
কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ ভস্ম হল না। একদল অবাঙালি নানা বয়েসী মহিলা মন্দিরে এলেন কোনো পুজোর জন্য গান গাইতে গাইতে। শিব মন্দিরে অমন আদিরসাত্মক লীলা দেখে একজন বয়স্ক মহিলা হাঁইহাঁই করে তেড়ে গেলেন। তারাও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আগের পোজ থেকে স্বাভাবিক হল। গোলমাল দেখে আরো মহিলারাও এগিয়ে গেলেন। রিলমেকারদের খুব একটা সাহসী মনে হল না। এরা বাংলায় কিছু বলতে চায়, অবাঙালিরাও তাদের উত্তেজক উপদেশে ধুয়ে দিতে চায়। এমনিতেই চারদিকে বাঙালি বেশ বিপন্ন শোনা যাচ্ছে, তায় এরকম একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটছে। উঠে গেলাম। যেতে যেতে তারাও গুটিয়ে নিয়েছে ক্যামেরাপত্তর। একজন জোর গলায় বলছে, ইনফ্লুয়েন্সার হতে গেলে কত কী সহ্য করতে হয় জানেন….. আমাদের কত ফলোয়ার জানেন?.... আরেকজন পুরুষ বাইকে উঠতে উঠতে বলল, ওসব ধর্ম নিজেদের রাজ্যে মারাবেন…..
তারা চলে গেল। সঙ্গে বিভূতি গেলেন। রবীন্দ্রনাথ গেলেন। আমার সামনে থেকে কিছুটা দূরে জগদম্বা। মাইকে গান গাইছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, তিলেক দাঁড়া ওরে শমন!
বৃষ্টি নামল। প্রাচীন বটবৃক্ষ গোটা মন্দির চত্ত্বরকে আগলে একাই দাঁড়িয়ে। আমি ছাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম। আজকাল ধনঞ্জয় ভটচাজ চালায় লোকে?
বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি নেমেছে জোর। তবু ভরসা আছে, এ গাছ পারবে আমাকে ভেজার হাত থেকে বাঁচাতে। বটবৃক্ষকে জিজ্ঞাসা করলাম, কত কীই তো দেখলে, কী মনে হয়, সব কি এইভাবেই ভেসে যাবে?
বটবৃক্ষ উত্তর দিল না। কিন্তু তার কালাতীত মৌনের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এ প্রশ্নটাই অবান্তর তার কাছে যেন!