Skip to main content

 

 

কানে কী আসছে…. সানাই? মাইক? মন্ত্র? ঘন্টার আওয়াজ? শাঁখের আওয়াজ? নাকি ঢাকের আওয়াজ…

দিদি…. দিদি…..

কাজল উঠল। উঠল না, তাকালো। সামনে শিরীষ গাছটা না? সকালের আলো পড়েছে…. সকাল হল? কখন হল?

কাজল কাল তাড়াতাড়ি কাজ থেকে বেরিয়েছিল। সন্ধিপুজোতে থাকবে না? তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছিল। হেঁটেই স্টেশানে আসে। কাল টোটো নিয়েছিল। টোটোতে উঠে থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছিল। মাথাটা ঘুরছিল। গা পাক দিচ্ছিল। এই তিয়াত্তর বছরের শরীরটার উপর দিয়ে তো কম ধকল গেল না। যারা ধকল দিল, তারা কেউ নেই আর। সে একাই থেকে গেল। কোনো কারণ নেই থেকে যাওয়ার, তবু সে-ই থেকে গেল। এই নার্সিংহোমে প্রায় বাইশ বছর হল কাজ করছে। ছুটি নেয় না। অসুস্থ হলে আলাদা কথা।

“দিদি…. জল নিন…. জল….”

ট্রেন বেরোচ্ছে একটা। এক্সপ্রেস ট্রেন হবে। এত জোরে ধুলো উড়িয়ে আর কে যাবে নইলে? কে জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে। চেনে না। কিন্তু তেষ্টাটা প্রচণ্ড পাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।

কোনো রকমে উঠল। হাতটায় ভর দিতে কাঁপতে লাগল হাতটা কনুই থেকে। তবু উঠতে তো হবেই। জলটা নিল। ছিপিটা খুলল বোতলের। গলায় ঢালল। একটু হাতে নিয়ে চোখে দিল। এই তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব। সামনে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়সী লোক। পাশে দুজন মহিলা। মা মেয়ে হবে। কারা এরা? সে এখানেই বা শুয়েছিল কেন?

কাজল রাতে স্টেশানে এসে পৌঁছেছিল যখন পাঁশকুঁড়া লোকাল ঘোষণা করছিল। তারপর? মনে নেই আর।

একটা বিস্কুটের প্যাকেট আর অর্ধেক ভরা জলের বোতল নিয়ে বসে কাজল প্ল্যাটফর্মে। যারা কিনে দিয়েছিল তারা চলে গেছে। জিজ্ঞাসা করেছে বাড়ি যেতে পারবে কী না…. সে “হ্যাঁ” বলেছে। মাথা নেড়ে।

ধুলো ওড়াতে ওড়াতে একটা মেল ট্রেন যাচ্ছে। সন্ধিপুজো হয়ে গেল? একশো আটটা প্রদীপ জ্বালা হল মণ্ডপে? নাকি যেন ক'টা প্রদীপ জ্বালায়? মাকে কী সুন্দর লাগে দেখতে। অপূর্ব। যেন জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া….. মাও তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকুক। ব্যস এইটুকুই।

সামনে চায়ের দোকানে মা কালীর ছবি ঝোলানো ক্যালেন্ডার। দুলছে। মা দুলতে দুলতে বলছে, ওঠ কাজল….ওঠ…. তোকে দেখব বলে বাঁচিয়ে রেখেছি আজও তোকে…. দেখ মরিসনি…. দেখ… এই দেখ আমাকে….আমি তাকিয়ে আছি…..

কাজল এই মুহূর্তে অনুভব করল তার কাপড় নোংরা হয়ে আছে। ছি… ছি…. ছি…. হিসি..পায়খানা হয়ে গেছে কাপড়ে…. মা…. ছি…. ছি…তাকাস না মা…..

কাজল উঠল। টয়েলেটের দিকে নিজেকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে গেল। বাইরে বসে এক পুরুষ। টাকা চাইবে। মা গো! মা নবমীতে যজ্ঞ হবে? হোমে বেলপাতা দেওয়া হবে….দেখ মা টয়েলেটের পিছনে ওটা বেলগাছ না?

কাজল পুরুষ মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল…. নাহ, কিছু বলল না। সোজা পায়খানায় গিয়ে, দরজাটা আটকে কাপড়টা টান মেরে খুলে ফেলল। তারপর সায়াটা। ইস! মা! ইস!.... মা এবারও পাড়ায় ঢাকির নাতিটা এসেছে। মা আমি জামা রেখেছি ওর জন্য। নতুন জামা। মা…. আমি দেব, তুই দিয়েছিস বলেই দেব…আমার সাধ্যি কী মা…. নইলে অমন পাঁচশো টাকার নোট স্টেশানে পড়ে থাকে? তুই রেখেছিস বলেই না…..

কলটা চালিয়ে শাড়িটা আর সায়াটা কলের তলায় ধরে আছে। সব নোংরা ধুয়ে যাচ্ছে। একটু সার্ফ হলে হত না? মা… ওমা… একটু সার্ফ হলে হত না…. মা…

হাওয়া দিল। টয়েলেটের উপরে যে ফাঁকটা ছিল, একটা সার্ফের পাতা এসে পড়ল। খোলা মুখ। একটু গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। কাজল বলল, মা….

কেউ রেখেছিল হাতে দেবে বলে। দিয়েছে, বাকিটা মা রেখে দিয়েছে তার মেয়ের জন্য।

কাজল সার্ফ দিয়ে শাড়ি সায়া ধুলো। ভালো করে নিংড়ালো। তারপর ভিজে সায়া শাড়ি পরে বাইরে এলো। রোদে দাঁড়ালো। আশ্বিনের শারদপ্রাতে। পুরুষ মানুষ যে বাইরে চেয়ারে বসেছিল, এক ভাঁড় চা আর একটা মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল, দিদি… মায়ের সন্ধিপুজোর প্রসাদ…. নিন…. আর চা-টা আমার বউ পাঠালো…. নিন….

কাজল চায়ে চুমুক দিল। দু ফোঁটা চোখের জল দুই গাল গড়িয়ে চায়ের ভাঁড়ে পড়ল।

পুরুষ মানুষ বলল, মা… আজকের দিনে চোখে জল আনতে নেই….. মা…

কাজল তার দিকে তাকালো। টয়লেটের দেওয়ালে দক্ষিণেশ্বরের মা। পাশে রামকৃষ্ণ আর সারদা মা। মা বললেন, তাড়াতাড়ি আয় কাজল, আজ নবমীর যজ্ঞ যে…… অপেক্ষা করছি…

কাজল রোদে হাঁটছে। ট্রেন ধরবে। রোদ শুকিয়ে নিচ্ছে ভেজা কাপড়। কাজল বলছে, মা…. আসছি।