ऐसी वाणी बोलिए मन का आप खोए
औरन को शीतल करे, आपहुं शीतल होए
(Aisi vani boliye, man ka aapa khoye,
auran ko sheetal kare, aaphu sheetal hoye)
এ কবীরের কথা। যার বাংলা মানে হল, গুমোর ছেড়ে দিয়ে কথা এমনই বলো, যাতে তোমার নিজের মনও ঠাণ্ডা থাকে, আর অন্যের মনও শীতল হয়।
কবীর ‘বাণী’ শব্দটার ব্যবহার করছেন। মানুষের সব চাইতে শক্তিশালী অস্ত্র। পারমাণবিক বোমেরও ক্ষয়ক্ষতি করার একটা সীমা আছে। ভৌগলিক সীমা আর সময় সীমা। কিন্তু শব্দের ক্ষমতা অসীম। সেই কোনকালে লেখা শব্দমালা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে, কাঁদাচ্ছে, হাসাচ্ছে, ভাবাচ্ছে, এমনকি প্ররোচিত করছে, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করছে। ভাগবতে লেখা হচ্ছে, “তব কথামৃতম”। যে কথায় অমৃত আছে। কী সে কথা? প্রাণদায়িনী কথা। রবীন্দ্রনাথ গাইছেন, “গাও বীণা বীণা গাও রে। নিরাশেরে কহো আশার কাহিনী, প্রাণে নববল দাও রে।” কিন্তু কথা শীতল হবে কী করে? কবীর বলছেন, মনের গুমোর ত্যাগ করতে হবে। কী করে?
বাস্তবে মন হচ্ছে এক সংশ্লেষণাগার। বাইরে থেকে সুখ, দুঃখ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি কাঁচামাল ক্রমাগত সরবরাহ চলেই আসছে। অহরহ সংশ্লেষ চলছে মনের মধ্যে। এদিকে মনের ভাঁড়ারঘরেও অনেক জাতীয় দ্রব্য সঞ্চিত আছে। গরল আছে, সুধা আছে। সেই সংশ্লেষাগারের মালিকের রুচির উপর নির্ভর করছে কীসের অনুপান বেশি হবে, কীসের কম।
এই ভাঁড়ারঘরে জিনিস আসে কী করে? কিছুটা সে নিয়েই জন্মায়। আর বাকিটা সে রুচি অনুযায়ী জমিয়ে রাখে। কেউ জমিয়ে রাখে গরল, কেউ জমিয়ে রাখে সুধা। মিশ্র ভাঁড়ারই বেশিরভাগ জায়গায় দেখা যায়। ওই “আমি দেখি চাঁদের আলো, তুমি দেখো কলঙ্ক” ধারার মনের গতিবিধি আরকি।
এখন সমস্যা হল, সংশ্লেষ যে হারে হয়, সেই হারে ডেলিভারি হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। ফলে উৎপাদিত বস্তু জমতে থাকে। এখন সে উৎপাদিত বস্তুতে যদি সুধার অনুপান বেশি থাকে সমস্যা হয় না। সেই অনুপানে যদি গরল বেশি থাকে তবে তো তা মনের মধ্যে জমে জমে মনের অন্দরমহলকেই বিষাক্ত করে তোলে। এমন বিষিয়ে যায় যে বাইরে থেকে সুধা এলেও তা গরলের দাপটে সংক্রামিত হয়ে টকে যায়। মুখ টক, মাথা টক, জিভ টক। সব টক তখন। সুখ কই? গোটা জগত এক প্রবঞ্চনার রাজ্য মনে হয়। মনের প্রথম দিকে যে তেজ থাকে তা তো দিনে দিনে ক্ষয় হয়। সে তখন এত গরল নিয়ে কী করবে? সান্ত্বনা খোঁজে। ঠাকুরদেবতা, ধর্মকর্ম, মনোবিদের কাছে। কিন্তু কাজ হয় না। মানে দীর্ঘস্থায়ী কাজ হয় না। হবে কী করে? এত বেশি গরলের স্টক জমে আছে যে সে স্টক ক্লিয়ারেন্স হচ্ছে না তো! উপর উপর খানিক শীতল বাতাসে কি ও মেটে?
এইখানেই কবীরের চাবিকাঠিটা। “মনকে আপা খোয়ে” অর্থাৎ মনের গুমোর ত্যাগ করে। “ঠেলে দে আড়াল, ঘুচিবে আঁধার, আপনারে ফেল দূরে/ সহজে তখনই জীবন তোমার অমৃতে উঠিবে পুরে”। রবীন্দ্রনাথের গান।
কিন্তু নিজের ভিতরের দিকে তাকালে তো এ দুরাশা লাগে। আর বাইরের দিকে তাকালে তো মনে হবে বড়বাজারের হইচইতে উস্তাদ আমীর খাঁ এর আভোগী শুনতে বসেছি যেন। তাই কি হয়? বাইরে ভেতরে এত তাপ! এ চাইলেই জুড়াবে?
অভিজ্ঞতা - জিনিস বড় মূল্যবান। বুদ্ধি-যুক্তি যা শেখাতে পারে না, ব্যথা-বেদনা-হেরে যাওয়া-হারিয়ে ফেলা অনেক কিছু শিখিয়ে যায়। আগে মানুষ শুধুই জানে। পরে মানুষ শেখে। চড়থাপ্পড় খেতে খেতে শেখে জীবন কী। সে বোঝে সে কারোর থেকে উৎকৃষ্টও না, আবার সে-ই যে একমাত্র জগতে বঞ্চিত-নিপীড়িত তাও না। সে নিজের জায়গাটা স্পষ্ট করে দেখতে শেখে। কারিগর ডেকে মনে আরো জানলা দরজা বানায়। আরো আরো বাতাস আসুক চায়। মনের মধ্যে সংশ্লষনাগারে তখন কাজ কম। সে বাইরে ভেতর এক করে বিশ্বের কেন্দ্রে যে সংশ্লেষনাগার সে ঘরে আমন্ত্রণ পায়। সে এক আশ্চর্য জায়গা। কালকূটের ‘নির্জন সৈকতে’ লেখাতে সে সংশ্লেষণাগারের কথা আছে। সেখানে অহরহ ভাঙাগড়া চলছে। সে এক আনন্দনিকেতন। “খুলে দেখ দ্বার অন্তরে তার আনন্দনিকেতন”। রবীন্দ্রনাথ গাইছেন। আর আমি? অল্প অল্প করে গুন গুন করে সুর মেলাতে চাইছি। আমার বিশ্বাস ওইটুকুতেই তরে যাব।