সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না অনেক কিছু। না, আমি উচ্চস্তরের পড়াশোনার কথা বলছি না। আমি সমাজের কথা বলছি। আমাদের কথা বলছি।
এই যে মাঝে মাঝেই পড়ছি না, মেয়েটাকে প্রথমে ধর্ষণ করছে ক'জন মিলে, চাষের ক্ষেতে বা পরিত্যক্ত কোনো জায়গায়। তারপর তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে মারা যাচ্ছে ক'দিন বাদে। ইংরাজি দৈনিকের প্রথম পাতায় মাঝে মাঝেই ছাপা হচ্ছে। এগুলো পড়ে যে অসহায়তা লাগে, যন্ত্রণা হয়, সেগুলো কেন হয় বুঝি। মানুষ হিসাবে যে ছবিটা আমাদের মধ্যে থাকে সেটা সম্পূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আসে বলে। কিন্তু যারা করে এগুলো, তারা কেন করে এ কি আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে আসে? আসে না। আমরা পশু, বর্বর এমন কিছু শব্দ বানিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি। কিন্তু তার মানে কি হয় তা কি জানি? না। খবরের কাগজে একজন মুখ্যমন্ত্রীর নাম দেগে দেওয়া হয়, কি কোনো একটা রাজ্যের নাম। ব্যস, আমাদের কাঁচা বুদ্ধি ভাবে এই তো ব্যাখ্যা পেয়ে গেলাম। কোনো কোনো অতিপণ্ডিত ক'টা মনোবিজ্ঞানের টার্ম শিখে 'সাইকোপ্যাথ', 'সোশিওপ্যাথ' ইত্যাদি দাগে দেগে দেয়, আমরা ভাবি এও বেশ।
সাধারণ বুদ্ধি এও জানে না কেন একজন মানুষ লোনের টাকা ফেরত না পেয়ে একজন অন্তঃসত্ত্বাকে ট্রাক্টরে পিষে চলে যায়, কেন স্নানরতাদের ছবি ভাইরাল করার ইচ্ছা হয়। এগুলো তো সব হালের ঘটনা নয়, এগুলো সব পৌনঃপুনিক ঘটনা। আমরা নানা ব্যস্ততায় ভুলে যাই তাই। ওয়েব সিরিজ আর কত অপরাধের কথা রসিয়ে রসিয়ে মনে রাখাবে! আসলে আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে কুলায় না যে, এত এত নিরীহ, নির্দোষ মানুষের অধিকার কেড়ে, স্বপ্ন পিষে লক্ষকোটি টাকা জমিয়ে জমিয়ে কি করে মানুষ সুখে থাকে!
এতদিন জানতাম প্রচুর পড়াশোনা করিনি, যাক্ বাবা আমার নিতান্ত সাধারণ মোটা বুদ্ধি নিয়ে আর বড় বড় বিদ্যালয়ে নাস্তানাবুদ হতে হবে না। কিন্তু তা তো হল না দেখি। এখন তো কাগজ পড়তে গিয়েই নিজেকে বড্ড নিরেট মাথামোটা লাগে। এত এত বিচিত্র ইচ্ছা মানুষের মনে জাগে কেন?
মেয়েরা সম্ভোগের বস্তু যে নয় এ কথা আমাদের শাস্ত্রে, নীতিতে এত শেখানো হয় কেন? মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে হয়, সম্মান করতে হয়, এ কথাই বা এত আলোচনা হয় কেন? মানে কি কোথাও আমরা জানি এ আমাদের চরিত্রগত নয়? তাই বাক্যের ঢালে আটকে রাখার ইচ্ছা?
যৌন আকর্ষণ থাকবে। এ প্রকৃতির নিয়ম। তা চরিতার্থ করার নানা উপায় সমাজ করেও রেখেছে। তারপরও কি বাকি থাকছে তা কি আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে কুলাচ্ছে? 'মণ্ডি' সিনেমা, যা একটা যৌনপল্লী নিয়ে বানানো, যার প্রধানের অভিনয়ে শাবানা আজমি, যিনি বুক ঠুকে বলেছিলেন, "আরে হাম হ্যায় তো সমাজ হ্যায়"। নইলে তোমাদের মনের বিকৃত বাসনা, অতৃপ্ত বাসনা কোথায় চরিতার্থ হত?
এ তো খাঁটি কথা। এই প্যাণ্ডেমিকে ইন্টারনেটে সব চাইতে বেশি খোঁজা হয়েছে পর্ণ সাইট। হ্যাঁ, অক্সিজেনের সিলিণ্ডারের থেকেও বেশি! মানুষের যৌন চাহিদার নানা কাল্পনিক রূপের পসার সেখানে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। যার যেমন রুচি তেমন খুঁজে নাও। সুবিশাল তার তালিকা। সবই তো আমাদের জন্য। আমাদের সুখী করার জন্য।
আরেকটু সফট চাও তো নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসো। সাধারণ মানুষ কি চমৎকার আগলহীন হয়ে নিজেকে মেলে ধরছে দেখো। কেউ বারণ করছে না। সবার লাভ হচ্ছে। তোমার গোপন সুখকে উস্কে, চাগিয়ে কারোর লক্ষ্মীলাভ যদি সমাজের অর্থনীতির দিক থেকে তা ক্ষতি কি?
বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া আরো আরো কুবের হচ্ছে। যে দুর্নীতি নিয়ে এত এত বাংলা কাগজে পড়ছ, সে তো নস্যি গো! আরো কত বড় ভয়ংকর নীতি নিয়ে আদিম রিপুদেরকে উস্কে ব্যবসা চলছে সে ভাগ্যে আমরা জানি না! কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, কেউ বুদ্ধিহারা হচ্ছে, কেউ মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। সব চলছে। আমরা দেখেও দেখছি না। কারণ? ওই যে মাঝে মাঝে সেমিনার হচ্ছে তো! বই লেখা হচ্ছে।
এক অনুল্লিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছি যেন। আমরা কে কত না দেখে থাকতে পারি! কে কত অসংবেদনশীল হয়ে বাঁচতে পারি। ডারউইন বলেছিলেন, যোগ্যতমের উদবর্তন। মানে যে যোগ্য হবে সেই টিকে থাকবে। হয় তো তারাই বেঁচে থাকবে যারা আরো আরো বেশি অসংবেদনশীল হতে পারবে। যারা অনেক অনেক বেশি নিজেকে নিয়ে নিজের মত করে ব্যস্ত রাখতে পারবে। তারাই হবে নব্যযুগের চালক। যারা মানবতাবাদী ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আশাবাদী ছিলেন, মানুষের একদিন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে, একদিন ফিরে আসতে চাইবে মানুষ হয়ে। হবে কি?