একটা সময় ছিল কুঁজো, ওয়াটার বোতল নিয়ে ট্রেনে উঠতাম। স্টেশান এলেই দৌড়ে গিয়ে জলের বোতল ভরে নিতে হত। বা অনেকক্ষণ ট্রেন থামার থাকলে কুঁজো নিয়েও দৌড়াতে হত। এ স্মৃতি অনেকেরই থাকবে।
একটা সময় ছিল যখন চাপাকলের জল ভারী এসে ড্রামে ঢেলে দিয়ে যেত। সেই ছিল কলের জল, রান্নার জল।
এই পানীয় জলের ধারণাই এখন কত বদলে গেছে। এখন প্রায় কেউই দৌড়ে গিয়ে স্টেশানের কলে জল ভরে না। এমনকি আনরিজার্ভড বগির যাত্রীরাও নয়। বোতলের জল কিনে নেওয়া হয়। ওটুকু খরচকে এখন মানুষ দরকার বলে জানে। বাড়িতেও আজকাল নানা ওয়াটার পিউরিফায়ার, নইলে কুড়ি লিটারের জল ইত্যাদি আসে। অবশ্যই পুরো ভারতবর্ষ তাই হয়ে গেছে তা অবশ্যই নয়। পানীয় জলের সমস্যা এখনও একটা জ্বলন্ত সমস্যা। কিন্তু আমি যা বলতে চাইছি তা হল পানীয় জলের প্রতি মানসিকতাটা আমাদের কিছুটা হলেও বদলেছে।
কি করে? অবশ্যই শিক্ষার মাধ্যমে। কি শিক্ষা, বিজ্ঞান? না, বাস্তবমুখী জীবনশৈলীর শিক্ষা। বিজ্ঞান তার সাধন, সাধ্য না। যদি তাই হত, বাঙালিকূল অন্তত যে পরিমাণ বিজ্ঞান পড়ে সেই পরিমাণে জ্যোতিষী চ্যানেলে চ্যানেলে, মোড়ে মোড়ে কল্কে পেত না। বিজ্ঞান নয়, জীবনশৈলী শিক্ষার প্রচার ভারতে হয়েছে। বেশ অনেক জায়গায় হয়েছে। রান্নাঘর, শৌচালয়, যৌনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন খানিক হলেও এসেছে।
তবে এই গোবরমাখাকূল, নানা জ্যোতিষীর চেম্বারে লাইন লাগানো কূল কারা? এই নানা কুসংস্কারের মূল কি? বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব? আমার তা মনে হয় না। বিজ্ঞান একটা বিষয়। তার আলো আমাদের চিন্তার জগতে প্রভাব ফেলে না, সে আলো আমাদের বস্তুজগতে নানা সুবিধা তৈরিতেই ব্যবহৃত হয়। যেমন আমি একটা অত্যন্ত উন্নতমানের মোবাইল ব্যবহার করেও রাশিফল দেখতে পারি ওই মোবাইলের স্ক্রীনেই। আমি একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হয়েও একটা বিশেষ দিনে অপারেশান নাও করতে পারি ক্ষতির সম্ভাবনায়। কারণ বিজ্ঞান আমাদের বাইরের জিনিস, ভিতরের জিনিস নয়।
কেন নয়? আমাদের ভিতরের জগতে দুটো দিক আছে। এক বুদ্ধি-প্রজ্ঞা-যুক্তি-বিচার, যা কগনিটিভ দিক। আর একদিক হল, আবেগ, অনুভূতি যা নন-কগনিটিভ দিক। আমাদের এই কগনিটিভ রাজ্য আবার নন-কগনিটিভ রাজ্যের সঙ্গে এমন জড়িয়ে যে তাকে আলাদা করা মানে রামকৃষ্ণের ভাষায় দুধ আর তার ধবলত্বকে আলাদা করা। ভাষায় দুটো আলাদা করাই যায়। যেমন আমি বলতেই পারি সাদা দুধ। যেন সাদা একটা বস্তু আর দুধ একটা বস্তু। বাস্তবে তা না হলেও ভাষায় সব কিছুকেই আলাদা করে অস্তিত্ববান করে তোলা যায়। শাব্দিক অস্তিত্ব দেওয়া যায়। তা দিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু জীবন চলে না।
জীবনশৈলী - একে প্রভাবিত করতে পারে যে, সেই ব্যক্তিগত জীবনে কি সমাজ জীবনে স্থায়িত্বলাভ করে। এই জীবনের শিক্ষা কি বিজ্ঞান দিতে পারে না? পারে, তবে ক্লাসরুমের মধ্যে ভাষায়, বইতে না। বাস্তবে। যেমন ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান বইতে হাত ধোয়ার কৌশল নিয়ে একটা অধ্যায় আছে। ওটা এতদিন তেমন গুরুত্ব পায়নি। নাম্বার তোলা ছাড়া। জীবনে গুরুত্ব দিল কোভিড। এখন অনেকেই বুঝেছেন ওই তিরিশ সেকেণ্ড ধরে নানা কৌশলে হাতটা পরিষ্কার করার পদ্ধতিটা আসলে শুধু নাম্বার তোলার সিলেবাস না। ওটা জীবনশৈলী।
তবে কথাটা সেই রবীন্দ্রনাথের কথাতেই ফিরে আসে, "জীবনে জীবন যোগ করা, না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা"। এ কথা শুধু গানের ক্ষেত্রে না, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা কুসংস্কার, একটা অন্ধবিশ্বাস জীবনের সঙ্গে এমন মিশে আছে যে বুদ্ধি ঢাকা সরিয়ে ঢুকতে চাইলেও ঢুকতে পারছে না। ঢুকবে কি করে। বুদ্ধি ব্যাখ্যা করতে পারে। উপলব্ধি তো করতে পারে না। ব্যাখ্যা মানে তো বোঝা নয়। আপাত বোঝা। তাই অনেকেই না বুঝেও ব্যাখ্যা করে। কিন্তু যে বুঝেছে সে অনেক সময়েই ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারে না। উপলব্ধি করে জীবন। বোধ। যেমন যে মানুষটা বিজ্ঞানের ছাত্র সে যখন সিগারেট ধরায় তার মানে সে বুঝিয়েই দেয় বিজ্ঞান তার জীবনের সঙ্গে মিশ খায়নি। সেও ওই গোবরামাখা দলের থেকে বা আঙুলে এক বিশেষ পাথরের মহিমায় জীবন বদলে যাওয়ার আশা নিয়ে ঘোরা মানুষের থেকে আলাদা নয়।
বিজ্ঞান আর মহাপুরুষের উপদেশের বই, দুটোই আমাদের জীবনের সঙ্গে মেশেনি। ওভাবে মেশেও না। জীবনের সঙ্গে মেশাতে গেলে বই না, লেকচার না, নানা সামিট না, মিটিং না, যা লাগে তা হল জীবন একটা। জীবন শুধু জীবনের ভাষা বোঝে। বাকি যা কিছু তর্ক-বিতর্ক শুধু রাস্তার ধুলো ওড়াউড়িতেই শেষ হয়। কেউ আসেও না, যায়ও না।