যমুনার তীর। কুয়াশা ঘিরে আছে কম্বলের মত। যমুনার পাড় ধরে ধরে রাস্তা। পরিক্রমা পথ। শয়ে শয়ে মানুষ চলেছে সারাদিন ধরে। গভীর রাতেও চলেছে। সংখ্যায় কম। আবেগে নয়। অনেকের খালি পা। অনেকের হাতে খঞ্জনি। জিহ্বায় রাধা নাম।
সেই যমুনার তীরে রামজির চায়ের দোকান। না না, অযোধ্যার রাজারাম না। কিন্তু সেই রাজারামজী একদিন স্বপ্ন দিলেন এই রামজীকে, বললেন ওরে আপদ, কোথায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। আয় বৃন্দাবনে আয়। তখন রামজীর বয়েস অল্প। যুবক। এলেন রামজী পরদিন সকালেই সব কাজ ছেড়ে বৃন্দাবনে, চিরকালের মত। পড়ে রইলেন এদিক ওদিক। রোগ হল। সেবা করলেন এক সন্ন্যাসী। এমনি এমনিই। সন্ন্যাসীর কাছে গেলেই কেউ সন্ন্যাসী হয় বুঝি। সাধন পেলেন রামজী। শ্রীরামেরই সাধন। কিন্তু একা কি সব সাধন হয়? এলেন সাধনসঙ্গিনী।
গল্প শুনছি রামজীর মুখে। পাশ দিয়ে একদল যুবতী গেল নূপুরের আওয়াজ তুলে, গাইতে গাইতে রাধে রাধে। চায়ের দুধ ফুটছে। ফিকা চা। মানে কম চিনির চা। রামজীর গল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হামানদিস্তায় কিছু গুঁড়ো করছেন সাধনসঙ্গিনী। মাঝে মাঝে সলাজ গর্বিত মুখে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন। এক ছেলে, বাইরে থাকে। সুরাটে। বড় ছেলে।
জিজ্ঞাসা করলাম, এই চায়ের দোকানের মধ্যেই তো সব। এইটুকু তো দোকান। কিভাবে চলে সব?
কি এক আজব প্রশ্ন করলাম যেন। খইনি বেটে হাতের তালুতে, ঠোঁটের মধ্যে পুরে বললেন, কি বলেন বাবু, শ্রী রাধার কিরপায় সব চলে যায়। কোনো দুখ নেই। আর দুখ হবে কি করে এই যে আমার রামজী আছে।
রামজী চা ছাঁকে। আরেক উনি পয়সার হিসাব রাখেন। পাশে বয়ে চলে যমুনা। বারোমাস। আরো দুটো হৃদয়ের খাতে বয়ে চলে গুপ্ত যমুনা বারোমাস।
একদল চা খাচ্ছে। একজনের পিঠে লেগে চায়ের কাপ গেল উল্টে। চা পড়ল মাটিতে।
চায়ের দামের হিসাব হচ্ছে। অনেকে তারা। হয়েছে ১৫২ টাকা। সঙ্গে বিস্কুট ছিল। কিন্তু ওই পড়ে যাওয়া চায়ের দামটা? ওটা তো আমাদের পিঠে লেগে পড়েছে।
আমাদের শিক্ষার নীতি। নির্ভুল। কিন্তু তারপরেও কিছু আছে তো।
রামজীর স্ত্রী বললেন, না গো, ওটা ধরিত্রীমাতা নিলেন। ওর কি দাম হয়? তুমি ইচ্ছা করে ফেলেছ, না আমি ফেলেছি? আমাদের ইচ্ছার বাইরে জগতে আরেক ইচ্ছা আছে। সেই ইচ্ছাই বলবান। সেই হয়। ওর দাম নিতে নেই।
এরপর কোনো কথা হয় না।
চায়ের দুধ বসাতে হবে। কিন্তু দুধের প্যাকেট শেষ। একজন সন্ন্যাসীকে চা খাওয়াচ্ছিলেন সেই বড় দলের কেউ। সন্ন্যাসীর চা শেষ হয়েছে এইমাত্র। রামজী বলল, রাধে তুমি গিয়ে দুপ্যাকেট দুধ নিয়ে এসো তো। এই নাও টাকা।
জিজ্ঞাসা করলাম, চেনো ওকে?
রামজী বলল, সবাইকে চিনি। তুমাকেও। সব প্রভু, রাধারাণীর বান্দা।
খানিকবাদে সে সন্ন্যাসী দুধ এনে দিল। ফেরত টাকা দিল। তারপর একগাল হেসে সবাইকে রাধে রাধে জানিয়ে কুয়াশা ঘেরা যমুনার তীরে মিশে গেল।
আমরা গ্লাসের ফিকে চা শেষ। মনে তীব্র আকুতি। এত ভরসা, এত আনন্দ, এত বিশ্বাস জীবনের এই পশ্চিমপ্রান্ত অবধি জমিয়ে আনো কি করে গো? এত অভয় কিসের আনন্দে?
বিকিকিনি শেষ। উঠলাম। রামজীর সামনে সদ্য ঢালা দুধ, ফোটার অপেক্ষায়। রামজীর গরবিনী দুটো পা ছড়িয়ে গল্পে মগ্ন। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আসবেন আবার, জানবেন কিরপা না হলে কেউ এ মাটিতে পা রাখে না। মনে রাখবেন।
ফিরছি যমুনার তীর ধরে। সন্ধ্যে নেমে গেছে। জীবনে স্থিতি চাইলাম, শান্তি চাইলাম না। হাজার অস্থিতির মধ্যেও শান্তিকে জেনেছি অনেকবার, কিন্তু স্থিতির মধ্যে সব সময় শান্তি পেয়েছি কি?