১
---
"জল নেই, আপনি বাইরের কলটায় যান, পাবেন।"
ভোর হচ্ছে। আমার পিঠটায় প্রচণ্ড ব্যথা। চেয়ারের জন্য। বাইরে এলাম। বাইরের ওয়াটার ফিল্টারের থেকে একজন নার্স জল নিচ্ছেন। নাইট ডিউটি ছিল নিশ্চয়। ক্লান্ত চোখ। আমি শ্লথ গতিতে এগোচ্ছি। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে নার্স তাকালো, মাথাটা অল্প কাত করে বলল, গুড মর্নিং। দক্ষিণ ভারতীয় মনে হচ্ছে। কেরালার হবে। কেরালার অনেক নার্স এদিকের প্রাইভেট হাস্পাতালগুলোয় কাজ করে। আমার ছেলের কেবিনে অবশ্য শুধু বাঙালি নার্স দেখেছি।
আমার ছেলে। বত্রিশ বছর বয়েস। সমকামী। এইডস্-এ আক্রান্ত। জীবনের শেষ কয়েকটা শ্বাস যখন বেঁচে তখন আমার কাছে ফিরেছে। ‘আরোগ্য নিকেতন’ পড়েছেন? জীবন মশায়ের ব্যথাটা আমি অনুভব করতে পারছি। তিনি চিকিৎসক ছিলেন। আমি সরকারি চাকুরে। জীবন মশায়ের ছেলে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেছিল। রত্নদীপ করেনি। দুবাইতে কাজ করত। ওর বয়ফ্রেণ্ড পুণেতে থাকে। এখন কলকাতায়। আমার ফ্ল্যাটে। আমরা পালা করে রাত জাগছি। আজ আমার পালা। ও নেগেটিভ।
আমার ছেলে ক্রিটিকাল। হয় তো এইটাই শেষ সপ্তাহ। প্রারম্ভ, না এটা কোনো বাংলা শব্দ না, আমার ছেলের বন্ধুর নাম, উচ্চারণের শেষে একটা হসন্ত দিতে হবে, 'প্রারম্ভ্', এইরকম। রত্নদীপ নিজেকে আমাদের কাছে প্রকাশ করে কলেজে পড়ার সময়। ওর মা মেনে নিয়েছিল। আমি মানতে পারিনি। আজও পারি না। চেষ্টাও করি না। জেদের জন্য না, আমার মনে হয় সেটা ওকে অপমান করা হবে। অভিনয় করে লাভ কি। আমরা দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে। তবু ও আমার ছেলে। সে পরিচয় ওর যৌনতার চাইতে অনেক বড় আমার কাছে। ওর মা আমায় মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, ঠিক বলেনি, আমার কাছে কথা চেয়ে নিয়েছিল, আমি যেন ওকে না মানতে পারলেও অপমান না করি। আমি সে কথা রেখেছি। প্রারম্ভ্ ওর কপালে চুমু খায় বেরোবার আগে। আগে অস্বস্তি লাগত। মুখ ফিরিয়ে নিতাম। এখন করি না। মনটা উঠিয়ে নিই। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ওদের অপমান করা। আমি ভীষণ কনফিউজড্। আমি কি ভুল? আমার বিশ্বাস, শিক্ষা সব ভুল? কোনো কোনোদিন আমার পাশের ঘরে প্রারম্ভ্ -এর কান্নার আওয়াজ পেয়েছি। কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে কাঁদছে। রাতের অন্ধকারে ফ্ল্যাটের ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়েও কাঁদতে শুনেছি। আমার অস্বস্তি হয়েছে। কান্না কি মিথ্যা কথা বলে? কান্না কি বিকৃত হতে পারে? ও যখন এয়ারপোর্টে নেমে আমার দিকে এগিয়ে এলো, আমায় আলিঙ্গন করল, আমি ওকে কিছুটা নিষ্ঠুরভাবেই সরিয়ে দিয়েছিলাম। ওর ভিজে চোখ উপেক্ষা করেছি। ও আমার সঙ্গে ফ্ল্যাটে আসেনি, সোজা হাস্পাতালে গেল। আমি ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছিলাম, একা। এখনও একা। দু'একজন করে এসে বসছে। আমরা সবাই সবাইকে চিনি। আমি কারোর সঙ্গে যেচে আলাপ করি না। লজ্জায়? জানি না। আমার মনে হয় অনেকে জানে। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। না, করে তো? ছেলে কেমন আছে? এ কথাটা অনেকে জিজ্ঞাসা করে। ওটা সৌজন্য। আমি জানি। আন্তরিক না।
আমার কয়েকজন বন্ধু রত্নদীপের মত ছিল। আমরা জানতাম, কিন্তু কেউ কাউকে বলতাম না। তবে ফিসফিসানি থাকত। সাহেবি সিনেমার কায়দায় দু-একবার হয় তো ‘ইউ ব্লাডি ফ্যাগট’ বলে গালিও দিয়েছি, সে হটটকের সময় কোনো। ব্যস, অতটাই। তারপর মোটামুটি সবাই বিয়ে করেছে। সুখে আছে কিনা জানি না, তবে বিয়ে তো করেছে। এখন এর ওর মুখে শুনি অনেক অসুবিধা, আমার বিশ্বাস হয় না। একটা আনন্যাচেরাল জিনিসকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কি আছে জানি না। শুভেন্দু'র সঙ্গে পিনাকির এখনও যোগাযোগ আছে। পিনাকি গে ছিল। ডিভোর্স হয়ে গেছে। গড়িয়াহাটে থাকে। শুভেন্দুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার কেন পিনাকি ছেড়ে দিল, অস্মিতা তো ভালো মেয়ে। ওদের দুটো বাচ্চাও আছে। কি ব্রাইট দু'জনেই! বাইরে থাকে। এই শেষ বয়সে এসে এটা কি ধরণের পাগলামি আমি বুঝতে পারি না। এতদিন যদি কাটানো গেল, আর কয়েকটা দিন যেত না? অন্তত মুখটা তো পুড়ত না!
২
---
আজ আবার আমার রাত জাগার পালা। প্রারম্ভ্ গতকাল ছিল। অল্প জ্বর এসেছে। তবু ছিল। ভীষণ জেদি ছেলেটা। আজ আমি একা না। আমার থেকে কিছুটা দূরে একজন বুদ্ধিস্ট মংক। পঞ্চাশের ঘরে বয়েস হবে। ওদের সঙ্ঘগুরুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে গতকাল। আমি তাকাতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার। আমিও নমস্কার জানালাম।
প্রারম্ভ্ টেক্সট করল, “আংকেল ডোন্ট স্মোক এ লট, অ্যাণ্ড ডোন্ট ড্রিংক কফি এ লট, নট গুড ফর ইউ”। আসলে গতকাল আমার প্রেশারটা বেড়ে গিয়েছিল। ড্রয়িংরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। টেবিলের কোনায় লেগে অল্প একটু কেটে গিয়েছিল, ছেলেটার চোখ এড়ায়নি। চোখ আছে ছেলেটার। হঠাৎ আমার বুকটায় কেমন একটা চাপ অনুভব হতে শুরু করল। প্যানিক অ্যাটাক? জানি না। নিজেকে একটু ডিস্ট্র্যাক্ট করতে হবে। ঘাম হচ্ছে। আমার এখানে কিছু একটা হয়ে গেলে? বাবুর কি হবে? অবশ্য প্রারম্ভ্ আছে ওর জন্য... আমার জন্য?... কেউ নেই... আমার মাথাটা অল্প ঘুরছে... অস্বস্তি হচ্ছে...
আর ইউ অলরাইট?
আমার পাশে বুদ্ধিস্ট সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে... আমার কি হল জানি না... আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললাম... অথচ রত্ন আসা অবধি আমি কাঁদিনি... এত কান্না পাচ্ছে আমি লজ্জা পাচ্ছি... নিজের মাথায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর হাতের স্পর্শ পাচ্ছি... আমি কাঁদছি...
ইটস নরম্যাল..., সব শুনে সন্ন্যাসী বললেন।
বাট হাউ ইট ক্যান বি?
সায়েন্স তাই বলে...
বাট লাইফ ইজ নট অল অ্যাবাউট সায়েন্স... সমাজ আছে... একটা ট্র্যাডিশান আছে...
অল ইজ চেঞ্জেবল... বুদ্ধ সেইড...
হ্যাঁ পড়েছি... বুদ্ধ সব কিছুই পরিবর্তনশীল বলেন... বাট...
ইয়োর বাট ক্যান চেঞ্জ অলসো... ইন ডিউ কোর্স অব টাইম... ইফ ইউ ডোন্ট প্লে ভেরি মাচ অবস্টিনেট...
অ্যাম আই?
প্রিটি মাচ...
সন্ন্যাসী হাসলেন, তারপর বললেন, ইউ আর পানিশিং ইউরসেলফ জাস্ট ফর নাথিং... ইউ ওয়ান্ট টু হাগ হিম... মে বি ওয়ান্ট টু গিভ হিম আ কিস... বাট ইউ ফিল অ্যাশেমড... নট এক্স্যাক্টলি ইউ ফিল... ইয়োর প্রেজুডিশেস কম্পেলস ইউ টু ফিল সো......
আমি চুপ করে বসে আছি। আমার সামনের চেয়ারে বসে সন্ন্যাসী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি জানি না আমার কি বলা উচিৎ এখন। এটা তো সত্যি মনের গভীরে কোনো সমাজ নেই, সময় নেই। সেখানে শুধু আমি আর আমার তৈরি জগৎ। আমি কি সেখানেই হেরে গেলাম তবে? আমি কি মৌসুমীকে ভালোবাসিনি? আমি কি সত্যিই প্রারম্ভের মত করে ভালোবেসেছি মৌসুমীকে? আমার মনে হয় না। আমি ভীষণ অহংকারী, স্বার্থপর চিরটাকাল। আমি ওভাবেই বড় হয়েছি। ছোটোবেলায় বাবা মারা যান। মামাবাড়ি মানুষ। নিজেরটা নিজে না বুঝে নিলে আজ আমায় হয় ভিক্ষা করে নয়তো ওদের বাড়ির ফাইফরমাশ খেটে জীবন কাটাতে হত। আমি না, আমার পরিস্থিতি আমায় এরকম করেছে। আমি ভালোবাসতে পারি না। কিন্তু কোথাও যেন নিজেই নিজের এই জাস্টিফিকেশান মানতে পারলাম না। মোবাইলটা অন্ করে প্রারম্ভের টেক্সটা অন্ করলাম, লিখলাম, ওকে, টেক কেয়ার। উত্তর এলো না। দশ মিনিট হল। ঘুমিয়ে পড়েছে হয় তো।
৩
---
রত্ন চলে গেল আরও চারদিন পর, বিকাল পাঁচটা পাঁচে। ওর মা ঠিক এই সময়েই চলে গিয়েছিল, এই হাস্পাতালেই। পাঁচটা কুড়িতে। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল না। আজ ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। রত্ন চলে যাওয়ার পর আমার কোথাও যেন একটা রিলিফ লাগতে শুরু করল। যেন সমাজের খাদে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রারম্ভকে সি অফ্ করতেও যাইনি। ও একটা ওলা ডেকে নিজেই চলে গেল। রত্ন'র ছোটোবেলার কিছু ছবি নিয়ে গেল। আমার মনে হল সব কেন নিয়ে গেল না? সব।
একদিন বিকালে বসে নেটফ্লিক্সে একটা মুভি দেখছি, হঠাৎ কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে দেখি শুভেন্দু আর পিনাকি। শুভেন্দু ফরম্যাল ড্রেসে, পিনাকি একটা নীল টি শার্ট আর জিন্স পরে। যেন ও আমাদের থেকে দশ বছরের ছোটো। মনে মনে বিরক্ত হলাম, অস্বস্তিতে পড়লাম। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ওপেন দ্যাট চ্যাপ্টার এগেন ম্যান। আই অ্যাম এঞ্জয়িং মাই লাইফ নাও... আই ফিল জাস্ট নাও আই হ্যাভ স্টার্টেড টু লিভ... আই নো আই সাউন্ডস ভেরি রুড... বাট ইটস দ্য ফাকিং ফ্যাক্ট ম্যান...
শুভেন্দু আমার পাশে এসে বসল। বলল, পিনাকি কি বলতে চাইছে শুনলে কি তোর খুব অসুবিধা হবে?
আমি নিরুপায়। ভদ্রতার খাতিরেই বলল, গো অন্...
পিনাকি বলল, দেখ, রত্ন ওয়াজ এ ব্রেভ ম্যান... আমি নিজে যা পারিনি, মানে আমাদের মত অনেকেই যারা পারিনি ও সেটা পেরেছে... আই থিংক উই শুড সেলিব্রেট দ্যাট...
বাট ফরগিভ মি... দে আর এঞ্জয়িং দেয়ার লাইফ... দে আর নট ক্রেজি লাইক ইউ...
কেউ ভালো নেই ভাস্কর... কেউ না... অভিনয় করে কেউ ভালো থাকে না... শুধু অভিনয়টা এত পার্ফেক্ট শিখে যায় যে ওটা আসলের মত মনে হয়... বাট বিলিভ মি... দে আর লিভিং এ মিজারেবল লাইফ... অ্যাণ্ড ডু ইউ নো হু হ্যাজ এনকারেজ মি..., হেল্পড মি টু মুভ অন..., অ্যাণ্ড লিভিং মাই ফাকিং ট্রু লাইফ? ... মাই ওয়াইফ... মাই চিল্ড্রেন্স... গ্রো আপ ম্যান... দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ চেঞ্জিং ফাস্ট...
শুভেন্দু আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, দেখ আমরা তোর লসে খুবই দুঃখিত... কিন্তু রত্ন ওয়াজ এ রিয়েল জেম... আমরা ওকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না... এটা ওর সঙ্গে ভীষণ অবিচার করা হবে রে...
পিনাকি আমার কাছে এসে বসে বলল, প্লিজ...
আমি বললাম, আমায় কি করতে হবে?
পিনাকি ওর ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বার করল। আমায় বলল, জাস্ট সি...
আমি হতবাক হলাম। ওদের কম্যিউনিটি হলে আগামী রবিবার রত্নদীপকে নিয়ে একটা বড় সভার আয়োজন হচ্ছে। অনেক এলজিবিটি কমিউনিটি স্পনসার করছে। প্রারম্ভ্ আসছে। আমাকে ওরা চিফ গেস্ট হিসাবে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে।
ওরা চলে গেল। আমার গোটা জীবন হঠাৎ কিরকম অর্থহীন মনে হল আমার কাছে। আমি কি তবে শুধু আমাকেই নিয়েই এতটা জীবন বাঁচলাম। কাউকে অনুভব করতে পারিনি? কাউকে না? আমার ওয়ালেট থেকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কার্ডটা বার করলাম... রিং হচ্ছে...।
অফ কোর্স আই উইল কাম ভাস্কর... রিমেম্বার ওয়ান থিং... উই অল আর কানেক্টেড... উই লিভ ইন এ ভেরি ইন্টারডিপেন্ডেন্ট, ইন্টারকানেক্টেড ইউনিভার্স... দ্যাটস দ্য লাইফ... এম্ব্রেস ইট হাও ইট ইজ... জাস্ট বি কম্প্যাশনেট টু ইউ অ্যান্ড টু দ্য রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড.. সি ইউ অন সানডে... টেক কেয়ার... বাই...
আমি প্রারম্ভ্কে টেক্সট করলাম..., স্টে উইথ মি বেটা দিস উইকেন্ড...