Skip to main content
 
 
       একটা নির্জন দ্বীপ। চারদিকে কেউ কোথাও নেই। একা বসে আছে একটা মানুষ। পাথরের উপর। তার সাথে কিচ্ছু নেই। না মোবাইল, না ইন্টারনেট। সে সম্পূর্ণই একা। অথচ তার একাকীত্বর বোধ নেই। সকালের সূর্য গাছের ফাঁক দিয়ে তার মুখের উপর এসে পড়েছে। সে চোখদুটো বন্ধ করে, হাতদুটো পিছনে পাথরের উপর রেখে শরীরটাকে এলিয়ে বসে আছে। পাখির ডাক শুনছে। ফুলের গন্ধ পাচ্ছে। সারা গায়ে ঠাণ্ডা বাতাসের আমেজ আসছে। পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। কানে আসছে কিছুটা দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন। 
       হঠাৎ সে যেন কিছু শুনল। কথা শুনল। অথচ মানুষের গলা নয়। চোখ মেলে তাকালো। আবার শুনল। এবার শুনল, সে যে পাথরের উপর বসে আছে, সেই পাথরের গায়ে একটা ছোট্টো ঘাসের মত গাছ, তাতে একটা অতিক্ষুদ্র নীল ফুল। সে কথা বলছে। জিজ্ঞাসা করছে, ভালো আছো? 
       মানুষটা পাথরের উপর শুয়ে পড়ল। তার কানের কাছেই নীল ফুলটা। মানুষটা আবার চোখ বন্ধ করে দিল। মুখের উপর রোদ এসে পড়ছে। এখন তার জগতে কটা বাজে, আটটা, নটা হবে। কত ব্যস্ত সবাই। কত দৌড়াদৌড়ি। উত্তর দিলে না যে? 
       মানুষটা আবার চোখ মেলে তাকালো। আকাশটা দেখা যাচ্ছে। নীল আকাশ। এই দ্বীপে সেই প্রথম মানুষ। আমি কেমন আছি? জানি না। 
       ফুল বলল, জানো না কেন? 
       মানুষ বলল, আমরা মানুষের মধ্যে যখন থাকি তখন কুয়াশার মধ্যে থাকি। নিজেদের ইচ্ছার, বায়নার, শখের, ঈর্ষার, লোভের কুয়াশায়। মানুষ মানুষকে দেখলেই হিসাব করে। যোগ্যতা নির্বাচন করে...
       পাথর বলল, চুপ করো। ওসব কথা থাক। আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমার ক্লান্ত হৃদয়ের আওয়াজ শুনছি। তুমি ভালো নেই।
       মানুষ বলল, আসলে আমরা কেউই ভালো নেই। আমরা জানি আমরা একটা গ্রহের বাসিন্দা, তাও ক্ষণকালের বাসিন্দা। এই গ্রহতেই এত সবুজ, এত বাতাস, এত জল, এত প্রাণ। তবু আমরা দিনে দিনে কিচ্ছু সহ্য করতে পারছি না। আমরা আমাদের মাটি, জল, আকাশ, মন, ভালোবাসা, ঈশ্বর, শিশু সব নষ্ট করে চলেছি। আমরা আমাদের ধ্বংসে মেতেছি, সাথে গ্রহটারও ক্ষতি করে চলেছি। 
       একটা সবুজ পোকা পাথরে উঠতে উঠতে বলল, তোমরা বড্ড পাঁচিল দাও। আমাদের পাথরে পাহাড়ে চড়তে কষ্ট হয় না, তোমাদের পাঁচিলে চড়তে বড্ড ভয় আমাদের, তোমরা বড্ড পাহারা দাও। 
       মানুষ বলল, আসলে আমরা শুরু থেকেই বড্ড লোভী। আমরা আমাদের সুখ ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না। তোমাদের সুখ আমাদের সুখের সাথে না মিললে আমরা সেই সুখকে আমল দিই না। আমরা সবাই ভীষণে সুখে আক্রান্ত। নিজেদের সুখের জালে আমরা আটকে। এর বাইরে আমাদের কিচ্ছু নেই। 
       একটা মাকড়সা জালের কোনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আমার জালের মত।
       মানুষ বলল, না, তোমার জাল তো এক ধরণের লালায়। আমাদের অনেক লালা। প্রথমে শরীরের লালা, তারপর মনের লালা, তারপর বুদ্ধির লালা, তারপর গোষ্ঠীর লালা। এত লালায় জাল বোনা আমাদের। এ সবের বুনট হয় অহংকারের লালায়। শরীরের অহংকার, বুদ্ধির অহংকার, গোষ্ঠীর অহংকার। 
       তোমাদের কি অহংকারেই সুখ? প্রজাপতি বলল, সে তার পাখা শুকাতে এসেছে পাথরে বসে। 
       বলতে পারো, আসলে তাই, আমাদের অহংকারেই সুখ, মানুষ বলল।
 
       সবাই চুপ। যারা এসেছিল চলে গেছে। মানুষ চুপ করে শুয়ে। মানুষের বাইরের মানুষ আর মানুষের মধ্যের মানুষ এত আলাদা কেন? আচ্ছা ভগবানকে ডাকলে হয় না? এখানে তো কেউ নেই, ওনার প্রাইভেসি নিয়ে তো কোনো রিস্ক নেই। 
       মানুষ যত যত নাম জানে সব ডেকে দেখল। ডাকতে ডাকতে তিনদিন হল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ডাকল। ডাকতে ডাকতে গলায় ঠাণ্ডা লেগে গেল। জ্বর হল। ফল খেল। পেটখারাপ হল। কোনো অ্যান্টাসিড নেই সাথে, অগত্যা বমি হল। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। সে আরো বেশি আস্তিক হল। একটা ঘর বানালো। তাতে একটা একটা পাথর রেখে তার উপর লিখল ভগবান। একটা মাঠে এসে দাঁড়ালো, সেখানে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির করে নিয়ে বলল, এও ভগবান। ওটা সাকার, এটা নিরাকার। 
       একটা শামুক একদিন জিজ্ঞাসা করল, এও কি তোমার অহংকারের সুখ? মানুষ বলল, না, আমার এ অহংকার ত্যাগের সুখ। 
       শামুক বলল, কে ত্যাগ করল?
       মানুষ বলল, আমি। বুঝেছি, তুমি বলছ এও অহংকার, সুক্ষ্ম বাতাসের মত, এও তাই। জানি। তবে এর মধ্যে একটা আনন্দ আছে। 
       শামুক বলল, আনন্দ আর সুখ কি তোমাদের আলাদা? 
       মানুষ বলল, আলাদা। সুখকে অর্জন করি, আর আনন্দে আত্মাহারা হই।
 
বছর গেল। এখন সে একা বসে থাকে। ভগবানকে আর খোঁজে না, পূজে না। দ্বীপের সবার সাথে তার পরিচয়। 
       একদিন সে সমুদ্রের ধারে শুয়ে। একটা সাদা পাখি এসে তার পাশে বসল। বলল,  কেমন আছো?
       মানুষ বলল, শান্তিতে।
       সাদা পাখি বলল, খুশী আছো?
       মানুষ বলল, আছি। 
       পাখি বলল, সে সুখ কি অহংকারের?
       মানুষ বলল, না, শান্তির। 
       পাখি বলল, আনন্দের উৎস কি তবে?
       মানুষ বলল, নেই, বাতাসের মত সে, তার কোনো উৎস নেই, স্রোত আছে। 
       পাখি বলল, তুমি সত্যকে পেয়েছ। সত্যের উৎস নেই। স্রোত আছে।
 
       মানুষ দ্বীপের মধ্যে রয়ে গেল। সে দ্বীপের কথা অনেক কাল পরে অমলকে বলেছিল ফকির আর ঠাকুরদা। সে ক্রৌঞ্চদ্বীপের কথা। সে পাখির দেশ সেখানে মানুষ নেই। তারা কথা কয় না, চলে না, তার গান গায় আর ওড়ে 
       অমল বলল, সে সমুদ্রের ধারে? ঠাকুরদা বলল, হ্যাঁ বইকি..
       সে দ্বীপে যাওয়ার রাস্তাটা ভিতর দিকে। হৃদয়ের সাবওয়ে।