সব ক’টা উনুনের তাপ শীতল
দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালো হরিহর
মাথার উপরে গনগনে চাঁদ
চাঁদের নীচে কৃষ্ণচূড়া
পাতার ছায়া মাটির উপরে
থেকে থেকে বাতাসে উঠছে দুলে দুলে
আকাশ জুড়ে এত তারা কেন?
হরিহরের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি কেউ কোনোদিন
সব তারাই অচেনা প্রতিদিন
তার রাতের অতিথি
তারার উপর দিয়ে ঈশ্বর হেঁটে যান রাতের বেলা
দিনের বেলা মাটির গন্ধে ঘুমান তিনি
প্রথম বৃষ্টির জলে জাগেন
হাসনুহানার গন্ধে
হরিহরের বুকের মধ্যে বন্ধ ঢাকনা গেল খুলে
সুখের গন্ধ উড়ে এল ধুপের গন্ধের মত
ঝিঁঝিঁপোকার তানে রাতের কুঁড়ি খুলছে পাপড়ি মেলে
সংসারে সব মানুষ একা
তারার মত একা একা জ্বলছে সবাই
নিজেকে ধরে কেয়াগাছের মত ঠেকনা দিয়ে
সারাদিন কত মানুষকে চা খাওয়াও হরিহর?
হরিহরের ভীষণ সুগার
শরীর জুড়ে মিষ্টি অবসাদ
সব স্বপ্নপূরণ হল হরিহর?
হরিহর স্বপ্ন দেখে না
স্বপ্ন মানে খেলনা
মাটির পুতুল
সাবধানে খেলতে হয়
পড়ে গেলেই চুরচুর
তখন ভাঙা পুতুলের কান্না দেওয়ালে, জানলায়
হরিহর সারাদিন চা খাওয়ায়
হাজার মানুষের গল্প শোনে
হারানো গল্পের খেই ধরিয়ে দেয়
মনে মনে কথা বলে
উনুনের সাথে, আগুনের সাথে, উথলে ওঠা দুধের সাথে
বুকের তাপে আগুন জ্বলে চোখের কোণায় চিকচিক
কান্নাতাপে পোড়া মাটির মত নিঃসন্তান হরিহরের বুক
হরিহর হাসতে হাসতে বিস্কুটের কৌটো খোলে
লুকিয়ে থাকা আরশোলা তাড়ায়
ইঁদুর ধরে, নদীর ধারে ছেড়ে দিয়ে আসে ভোরে
এখন হরিহর একা
মানুষ বাঁচে কল্পনায়
পশু বাঁচে জড়ের বাস্তবতায়, কারাগারে
হরিহরের কল্পনায় বেহাগের সুর
কখনও দরবারি, কখনও মালকোষ
সব রাগই অন্ধকারের
হরিহর বাঁশি বাজায়
বাঁশিকে কাঁদায়
নিজেকে বলে, আর না, আর না, আর না
রক্ত থেকে সুগার কমে
হরিহরের জিভ শুকায়
সারা শরীর ঝিনঝিন করে,
হাতের ভার, পায়ের ভার হালকা হয়
মাথাটা ঘোরে
এক-এক সময় ভাবে, দেখি না হয়
মরলে কেমন তারা ছোঁয়া যায়
ঈশ্বরের পায়ে হাত রাখা যায়!
হরিহর তবু ফিরে আসে
চিনির দানা মুখে পোরে
আবার শান্ত শরীর
এতবড় আকাশ, এত লক্ষকোটি তারা, এত যোজন যোজন মাটি
এসব কি তার?
মোটেও নয়
দোকানের এককোণে মাদুরে শুয়ে ওই যে---
তার লক্ষ্মীমণি
শ্যাওলায় লাগা শাপলা ফুল,
হরিহর বলে
লক্ষ্মীমণি হাসে
হরিহর জর্দাগন্ধে চুমু খায়
আবেশ আসে
কান্না আসে
ভালোবাসা প্রাণের আঁকশির মাথায় চড়লে কান্না হয়
হরিহর কাঁদে
আঁকশির মাথায় ধ্রুবতারা ফোটে
শিবমন্দিরে কে যায়?
দাঁড়াও আমি যাব
লক্ষ্মীমণি, চলো চলো
কত রাত?
চারটে হবে
লক্ষ্মীমণির হাত ধরে হরিহর হাঁটে
শিবমন্দিরে একা শিব
গোটা আকাশ, অগুনতি তারা, জল-মাটি’র অধিপতি
তাদের সন্তান
হরিহরের কাছে বাতাসা চায়
লক্ষ্মীমণির কাছে আদর
হরিহর বাঁশি বাজায়
ভোরের রাগ
ললিত, রামকেলী, কি ভৈরব
সূর্য ওঠে
আঁচের ধোঁয়ায় সূর্যের আলো আঙুল বোলায়
প্রথম মানুষ আসে, চায়ের তৃষ্ণায়
বেঞ্চে বসে
হরিহর লুকিয়ে পড়ে
জন্ম নেয় চা-ওয়ালা মানুষ একটা
সমাজ তাকে যেরূপে ভালোবাসে
মানুষ মানে বহুরূপী
সমাজ মানে বহুরূপীর মেলা
হরিহর গল্প শোনে
রাতের অপেক্ষায় বাঁশির সুর ভাঁজে
পাঁজরের খাঁজে খাঁজে
উনুনের তাপে
একা একা
আড়চোখে শুধু লক্ষ্মীমণি ঠেকে
(ছবি - Suman)