হংসেশ্বরী মন্দিরে সন্ধ্যারতি হচ্ছে। সামনে বড় চাতাল। খোলা আকাশের নীচেই মানুষ দাঁড়িয়ে। হাত জোড় করে। ঢাক বাজছে। সেই ভিড়ের এক পাশে বাবা তার মেয়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে। মেয়েটা টাল খেয়ে যাচ্ছে। এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন তাকাচ্ছে। হেসে উঠছে। মাঝে মাঝে বাবার হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাকে ধরে রাখার। আবার পরক্ষণেই সে শান্ত হচ্ছে। বাবা আকাশের দিকে আঙুল তুলে তারা দেখাচ্ছে। সে হাসছে। চাঁদ দেখাচ্ছে। সে হাসছে। তারপর একটা জায়গায় বাবা বসে মেয়েকে বসাতে চাইল। মেয়ে বসছে না। সামনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। বাবা উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করছে। কী বলেই যাচ্ছে। ঢাকের আওয়াজে কিছু কানে আসছে না। খানিকবাদে, সেই পনেরো কি ষোলো বছরের মেয়ে বাবার কোল ঘেঁষে বসল। যেন কোলেই বসল। অসহায় বাবার মুখে ক্ষণিক স্বস্তির রেখা ফুটল।
======
ঈশ্বরগুপ্ত সেতুর উপর সে সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে ওঠাচ্ছে। পা টলছে। তার বোধ ডুবে গরম তরলে। সেতুর মধ্যখানে এসে সাইকেলটা স্ট্যাণ্ড করল। তারপর গঙ্গার দিকে দুই হাত জড়ো করে “জয় শ্রীরাম” করে চীৎকার করতে লাগল। এক এক জায়গায় দাঁড়ায়, চীৎকার করে হাত কপালে ঠেকিয়ে। আবার অন্য জায়গায় দাঁড়ায়, আবার চীৎকার করে। একটু বাদে সাইকেলটায় চড়ে বসল। ঘোড়া চালাতে না জানলে যেমন ঘোড়া বাগে আসে না, সাইকেলও তেমন গড়িয়ে সেতুর মাঝখানের দিকে চলে আসে প্রায়। দুদিক দিয়েই প্রচণ্ড জোরে গাড়ি যাচ্ছে, কিন্তু তাতে তার কী? সে একবার নামে, একবার ওঠে…এই করে করে মিলিয়ে গেল ভিড়ে।
======
ধূপকাঠি জীবনের প্রাথমিক চাহিদা না। কিন্তু ধূপকাঠি বাজারে নিয়ে বসলে প্রাথমিক চাহিদা মিটতে পারে। তেমন, বড়িও খিদে মেটানোর খাদ্য না। কিন্তু রান্নার সাজসজ্জায় কাজে তো লাগে। সেই জিনিস বিক্রি করেও কাজ চলে।
শপিংমলের সামনে, উচ্চশ্রেণীর রেস্তোরাঁর সামনে হাতে ধূপের প্যাকেট, বড়ির প্যাকেট….কয়েকজন বৃদ্ধ…খুব বেমানান। ওই বেমানান হয়ে যাওয়াটাই তো চোখ পড়ানোর জন্য। নইলে বাজারে এলে এসে দাঁড়ালে রাস্তায় এতজন….আলাদা করবে কী করে?
আত্মধিক্কার। ক্ষোভ। ব্যর্থতা। ঠকে যাওয়া। সব আছে। কিন্তু বেরোনোর উপায় নেই। নেশার কাছে বা পরিস্থিতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় কই? সুখ নেই। সামঞ্জস্য নেই প্রয়োজন আর উপার্জনের। সততা নেই সমাজের ক্ষমতাশালী মানুষদের। নিজের অধিকারের জিনিস পেতে হয় অন্যের অনুগ্রহে। এদিকে জীবন গড়িয়ে সায়াহ্নে এসে দাঁড়ায়। মন খতিয়ে দেখে কী জমল, কী হল, কী কী বিপদাপদ দূরে ঠেকাতে পারল। ক্ষতি, ক্ষতি আর ক্ষতি।
আশ্চর্য হল, তবু এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ করে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই করে না। এ এক অদ্ভুত আশ্চর্য। এত অসামঞ্জস্য, এত অন্যায়, এত শোষণ মানুষ কীভাবে সামলে নেয়। কী করে পারে?
কেউ বলবে মানুষ আশাবাদী বলে, বা মানুষ অত তলিয়ে ভাবে না বলে, বা মেনে নিতে নিতে মেরুদণ্ড ভীষণ নমনীয় হয়ে গেছে বলে। দৈব বলো, সমাজ বলো, সবই তো অদৃশ্য ক্ষমতার শিরা উপশিরায় সুচারু স্পষ্ট বিন্যাস। সঙ্গে ভাগ্য, কর্মফল, গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাখ্যাও তো আছে। মানুষ নিজের নিজত্বটুকু পিষতে পিষতে চলেই যায়।
এর কোনো উত্তর নেই। হয় তো সত্যি এটাই মানুষের টিকে থাকার, বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা। যে ইচ্ছাকেই সে নানা রঙে রাঙিয়ে নেয়।
কিন্তু এর মধ্যেও একটা সত্য আছে দেখেছি। মানুষ অনেক অনেক দুর্ভাগ্যের কালো ছায়ায় বাঁচতে পারে। কিন্তু নিজের বানানো নিজের ছায়ায় বাঁচতে পারে না। সে ছায়া সব চাইতে ঘন অন্ধকার। মন যখন বিকল হয়ে নিজের রাস্তা নিজেই আটকে দাঁড়ায় মানুষ তখন সব দিক থেকে মরে। মৃত মন বয়ে নিয়ে বেড়ানো জীবিত শরীর - এর চাইতে ভারী কী আছে আর? মন মানে কী? মাথা। মাথা কী? চিন্তা। চিন্তা মানে একটা ধাঁচ। একটা ঢাল। জগত সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। মনের সব ঢালটা যখন নিজের উপর নিজেই এসে পড়ে তখন সেই চাপে নিজেই মরে মানুষ।
সব শান্ত। গভীর রাত্রি। চিতা জ্বলছে এদিক ওদিক। ছাই হয়ে যাচ্ছে সব কয়েক মুহূর্তে। গোটা জীবনের সব ক্ষণ ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে লহমায়। বিস্মরণে চলে যাচ্ছে সব সুখদুঃখের ধারাভাষ্য। ছাই কী সুখী, না দুঃখী? সুখী মানুষ বলে কিছু হয় কি? জমানো মানুষ, হারানো মানুষ হয়। হওয়া মানুষ, না হতে পারা মানুষ হয়। কিন্তু সুখী মানুষ বলে কী হয়? ছাইকে জিজ্ঞাসা করো, কিছু হয় না। রাশি রাশি চিন্তার ভার শুধু। তার মধ্যে ভয় আর অতৃপ্তিই সার। শান্তি কই?
যদি এর পরেও শান্ত থাকো, দেখো এই মহাশ্মশানে ধীর স্থির ধ্যানমগ্ন মহাকাল। উদাসীন। সমস্ত বোধ, সমস্ত চিন্তা যেখানে নিজের উৎসে গিয়ে শান্ত। সেখানে শুধু ধ্বংসের পর ধ্বংস হয়ে চলেছে। লীন হয়ে যাচ্ছে সব কোন শূন্যে যেন। কে প্রশ্ন করবে আর, এরপর কী?