Skip to main content

হরেনের শাড়ির দোকানের সামনে দু'জন পাগল, আর একজন ভীষণ বোকা লোক বসে থাকে। হরেন দোকান খুললেই ওরা এসে বসে। হরেন দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাড়ি গেলে ওরা সামনের পুকুরে নেয়ে যে যার বাড়িতে যায়। আবার বিকেলে হরেন দোকান খুললে ওরা এসে বসে। হরেনের বয়েস ষাটের কাছাকাছি। বাকি সবাই চল্লিশের নীচে। তার চাইতে বড় কথা হরেনের আত্মীয় এরা সবাই লতায়পাতায়। হরেন যদিও ওদের কথা শোনে না মন দিয়ে খুব একটা, বেশিক্ষণ শুনলেই মাথা ঝিমঝিম করে। এই তো গতকাল, দোকানের সামনে একটা পুলিশের জীপ এসে দাঁড়ালো। এরা সবাই গিয়ে তাড়াতাড়ি জীপে উঠে বসল, বলে পুলিশ নাকি ওদের ধরতে এসেছে। বড়বাবু ফাজিল মানুষ, তাছাড়া এ গাঁয়ে অনেকদিন, সবাইকে চেনেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তা তোমাদের অপরাধটা কি বলো তো?

একজন পাগল বলল, আপনি জানেন… তাই না?

তখন বোকা যে সে বলল, স্যার আবার জানে না, কিন্তু বিচারের আগে বলা বারণ.. তাই না স্যার?

বড়বাবু বললেন, নাম নাম…. তোদের মাফ এ বেলা….

তারা নেমেই বড়বাবুর পা জড়িয়ে কি কান্নাকাটিই না শুরু করল!… আপনার মহান প্রাণ স্যার…., এইসব বলেটলে কেঁদেকেটে সারা। বড়বাবু চলে গেলেন। সন্ধ্যাবেলা তারা সারা গ্রাম মিষ্টি দিয়ে এলো। তারা নাকি ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে।

=====

লোকে খুব বুঝেশুনে হরেনের দোকানে যায়। ওরা যে কাউকে বিরক্ত করে তা নয়, এটাসেটা প্রশ্ন করে বসে, এই যেমন মদন মাষ্টারের বউ আর শাশুড়ি শাড়ি কিনতে এসেছে দোকানে, তো পিন্টু পাগলা বলল, ওমা স্যার বুঝি আবার বিয়ে করলেন!

ব্যস, অমনি বোকা বলাই বলল, কি যে বলিস, উনি কেন মদন মাষ্টারের বউ হবেন, উনি তো মদন মাষ্টারের ননদ, আমি দেখেচি ওকে আগে শিয়ালদা স্টেশানে, লটারির টিকিট বিক্রি করেন, তাই না মা?

মদন মাষ্টারের শাশুড়ির আর শাড়ি কেনা হয়নি। হরেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, তোদের নিয়ে যে কি করি!

আরেকবার বিজলি এই গ্রামে বউ হয়ে এলো। পোষ্টমাষ্টারের বউ। সে এসেছে শাড়ি নিতে বরকে নিয়ে, বলাই বোকা বলল, বৌদি দাদা তোমাকে উপুড় করে শুইয়ে ধমাধম স্ট্যাম্প দেয়, সব চিঠিতে দেয় জানো…. কচুয়া পোস্ট অফিস আর তারিখ লেখা থাকে…. দেখেছ?

পোস্টমাষ্টার ইশারায় বলল, চুপ থাকতে। পিন্টু পাগল বলল, দাদা বৌদিকে নিয়ে তারকেশ্বর চলো, মানত করবে, বাচ্চা হবে।

ঘন্টা পাগল বলল, মানত করবে তো তারাপীঠ গেলেই হয়। তক্ষুনি বলাই পাগল বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথের বাচ্চাও তো ওখানে মানত করেই, আমি পড়েছি।

পোস্টমাস্টার কোনোমতে শাড়ি কিনে নিয়ে বাড়ি যায়।

=====

তবু হরেনের শাড়ির দোকান চলে। কেন? এক, ব্যবহার খুব ভালো হরেনের। দাম ঠিক নেয়। আর এসবের থেকে বড় কথা হরেনের একটা রুচি আছে। বড়বাজার থেকে এমন সব শাড়ি আনে সে যে চোখে দেখে তার আর দোকানে ফেলে রাখতে ইচ্ছা করে না।

হরেন বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। পিন্টু পাগল আর ঘন্টা পাগল বসে বসে লুডো খেলছে। বলাই বোকা একটা সাদা কাগজে বাঁদিক থেকে ডানদিকে গোল করার চেষ্টা করছে পেন্সিল দিয়ে। হচ্ছে না, আবার মুছছে। বেলা দশটার কাছাকাছি হবে। রবিবার। সকালটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। স্টেশানের দিকে লোকের দৌড় নেই তেমন। হঠাৎ করে বলাই বোকা বলল, এই পিন্টু-ঘন্টা, একটা আইডিয়া এসেছে, রিল বানাবি? আমরা জোক্স বলব, পুকুরে স্নান করব, তারপর তোরা দু'জন মাঠে হাগবি আমি ভিডিও করব, শহরের লোক তো গ্রামের মানুষের হাগা দেখেনি, করবি?

পিন্টু বলল, কিন্তু আমি শুনেছি রিল বানাতে গেলে থানা থেকে পারমিশান লাগে। ঘন্টা বলল, পঞ্চায়েতেরও। প্রধান কাকিমাকে দিয়ে লিখিয়ে আনতে হবে। বলাই বলল, সে আমি ম্যানেজ করে দেবখন, চল তবে কাল থেকেই। প্রথম শুরু হবে টুম্পা সোনা নাচ দিয়ে। তুই ঘন্টা কাকিমার নাইটিটা পরে আসবি, আর তুই পিন্টু কাকুর লুঙ্গিটা। আমরা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে করব। ফাঁকাই থাকে।

হরেন খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে বলল, তবে তো আর দোকানে বসবি না নাকি?

=====

হরেনের প্রথম প্রথম কয়েক মাস ফাঁকা লাগত। ওরা তিনজনে স্কুলে হেডস্যারের বকা খেয়ে এখন পুকুর পাড়ে একটা ভাঙা চণ্ডীতলায় রিল বানায়। প্রায় দু'বছর হল। পিন্টু তো এখন প্রায় সারাদিন মেয়ে সেজে থাকে। ঘন্টা একটা বাইক কিনেছে। বলাই টিনের ছাউনি ফেলে পাকা ছাদ বানাচ্ছে। তাদের রিল নাকি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। মাঝে মাঝেই শহর থেকে ছেলেমেয়েরা আসে। হরেনের দোকানটা যেহেতু স্টেশান থেকে গ্রামে ঢুকতেই, তাকেই বেশিরভাগ লোক জিজ্ঞাসা করে, পাগলা পিন্টুর বাড়ি কোথায়? পাগলা ঘন্টা কি এই গ্রামে থাকে? বলাই বোদ্ধার কি এখানে বাড়ি?

হরেনের কষ্ট হয়। কেন হয় বোঝে না। তাদের নিয়ে মাঠে, পুকুরধারে তারা তামাশা করে। ভিডিও করে। পিন্টু আর ঘন্টা বউ আর বর সেজে নাচে। বলাই ভুল ইংরেজি আর হিন্দিতে বক্তৃতা দেয়। যারা শহর থেকে আসে হাসতে হাসতে পেট চেপে মাটিতে বসে পড়ে। এদের হাতে টাকা দিয়ে যায় কেউ কেউ।

হরেন একবার ভাবে কিছু বলবে, বলে না, যা হোক টাকা তো আসছে।

=====

পিন্টু হঠাৎ গলায় দড়ি দিয়ে মরল। কেউ বলে পিন্টু মেয়েদের শাড়ি পরত বলে কোনো মেয়ের বাড়ি রাজী ছিল না বিয়ে দিতে, কেউ কেউ বলে নাকি মাঝে ওদের ভিডিও ঠিকঠাক ভিউ পাচ্ছিল না বলে নাকি।

হরেন ভাবল, এইবার হয় তো সব মিটবে। হয় তো ওরা আবার আগের মত হবে। না হয় তার দোকানে এসেই বসবে। বসুক। ক্ষতি হয় হোক। কিন্তু… মাঝে তো শুনেছিল পিন্টু নাকি কি একটা গানের রিল বানাতে গিয়ে ল্যাংটো হয়ে পিছন ফিরে নেচেছিল। ছি ছি!

'দিনে সব শান্ত হল। লোকে বাইরে থেকে এসেওছিল কেউ কেউ। কিন্তু ক'দিন পরেই আবার একটা ছেলে পাশের গ্রাম থেকে এসে বলল, আমাদের সঙ্গে তোমরা কাজ করবে? রিল বানাবে?

হরেন অবাক হল। দেখল তাদের গ্রামের ছেলেরা মেয়ে সেজে সেজে রিল বানাচ্ছে বলাইয়ের বাড়িতে এসে। কেউ কেউ বলে, খুব নোংরা নাকি ভিডিওগুলো। কেউ কেউ বলে, শহরের লোকেদের কাছে এসব নোংরা না, এগুলো ওদের কাছে স্মার্টনেস। এগুলোই চলে এখন।

হরেন বিএ পাশ করেছে। কিন্তু তাদের দিন, আর এখনের সময়? তবু ওদের দেখার জন্যেই স্মার্টফোন কিনেছে। প্রায়ই দেখে ওদের চ্যানেল। ওদের দেখে বলে আরো অনেক ধরণের চ্যানেল আসে। কত বরবউ একটু অসভ্যতা করে বলে বাকিটা দেখতে এখানে ক্লিক করুন। হরেন করে না। লজ্জা লাগে। তবে জানে আজ না হয় কাল করবেই। কারণ ধীরে ধীরে লজ্জাটা কেটে যাচ্ছে হরেনের। দোকানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা রিল দেখে। এক-একসময় মনে হয় সে আর তার মেয়ে-বউ তো ভালো গান গায়। যদি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে গান গায়? এটা লোভ, না চাহিদা ঠিক বোঝে না হরেন। কিন্তু শুচিস্মিতা, মানে তার বউ রাজি না বলে তার রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়। তার মেয়ে অবশ্য 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলে না। প্রথম প্রথম হরেন আশা করেছিল মেয়ে সঙ্গ দেবে। কিন্তু একদিন মেয়ের ইনস্টাগ্রামের প্রোফাইল দেখে বুঝল সে অন্য কিছু করতে চাইছে। যে সব গানে ও নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অভিনয় করছে সে সব গান তো ও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গায় না!

কে ভুল আর কে ঠিক আর বুঝতে পারে বা হরেন। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনটা লোভ আর কোনটা ঠিক তাও বুঝতে পারে না। সারাদিন মাথাটা ঘেঁটে থাকে। শাড়ির দোকান আর ভালো লাগে না। মনে হয় সবাই দৌড়াচ্ছে, জিতে যাচ্ছে, সে-ই শুধু পিছিয়ে যাচ্ছে। জগৎ জুড়ে যেন এক বিশাল লটারিখেলা শুরু হয়েছে। সে কেন যেন কিছুতেই পৌঁছাতে পারছে না টিকিট অবধি। হয় পৌঁছাবে একদিন, নয় হারিয়ে যাবে, খুব ভয় হয় হরেনের।