Skip to main content

 

333.jpg

 

“আমার হৃদয় হইতে বাহির হইয়া কেমনে আছিলা তুমি?”

বারবার গাইছে সে এই পদটা। “আমার হৃদয় হইতে বাহির হইয়া কেমনে আছিলা তুমি?”

রাধাগোবিন্দ মন্দির। মাটির মন্দির। মাটির প্রতিমা। শীতের সকাল। কুয়াশা কেটে সূর্যালোকের আসতে দ্বিধা। তবু এসেছে। ক্ষীণ আলোয়। সঙ্কোচে।

গায়কের দুটো চোখ বন্ধ। গায়কই পদকর্তা। ডুবতে গেলে চোখ বন্ধ করতে হয়। সঙ্গমের তুঙ্গ মুহূর্তেও মানুষ বন্ধ চোখ, আবার হৃদপদ্মের জ্যোতি ধরে ধরে ডুবতে ডুবতেও মানুষের বন্ধ চোখ। কেউ কেউ দীঘির ধারে আসে পা ধুতে। কেউ কেউ এঁটো বাসন ধুতে। তারা ফিরে ফিরে যায়, ফিরে ফিরে আসে। কেউ কেউ ডোবে। এ দীঘিতে ডুবলে প্রাণের মরণ নেই। মরণের মরণ। লোকলজ্জার মরণ। সুখের মরণ।

“কলঙ্ক তিলক কপালে এঁকেছি, লোকলাজ ভয় করি না”।

জ্ঞানদাসের বুকে শ্রীরাধার অভিমান। অভিমান অভিসারের পরে জন্মায়, না আগে? পরেই সে আসে। তার আগে অভিমান সম্ভব? অদর্শনে প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। অভিমান জন্মায় কী করে তখন? অত যাতনা অভিমান সইতে পারে না। কিন্তু তাও কোথাও যেন ভুল হচ্ছে। তবে কী সত্য?

অদর্শনের প্রথম অধ্যায়ে অভিমান। তারপর তীব্র যাতনা। তারপর দর্শন। তারপর তো আত্মনিবেদন। অভিমান নেই তো তখন? কিন্তু একেবারে কি নেই? এই যে সামনে শ্যাম। কী যাতনাই তো পেল শ্রীরাধা। একটুও অভিমান হবে না?

জ্ঞানদাস চোখ খুলে তাকালো। বাইরে কুয়াশা কাটছে। মন্দিরের পিছনে বড় যে দীঘি তার পাড়ে গিয়ে বসল। অভিমানের সূত্র কী তবে?

… কী হবে শ্যামকে দর্শন করে? তার বাইরে ভেতরে আলাদা। তেল আর জলের কি প্রীতি গাঢ় হয়? মুখে তার মধুর বাণী, কিন্তু ভিতরে? যেন বিষঘটে দুধের উপহার!... চাতুরি বেচহ গাহক ঠাম/ গোপত প্রেম সুখ ইহ পরিণাম….

কিম্বা বর্ষায় লিখেছে তো জ্ঞানদাস….

মাস সাঙনে/ আশা নাহি জীবনে/ বরখিয়ে জল অনিবার……ভাদর দর দর/ অন্তর দোলন/ মন্দিরে একলা অভাগী…..

জ্ঞানদাস আজীবন যেন অভিমানের সূত্র খুঁজে চলেছেন। স্বার্থগন্ধহীন প্রেমে অভিমান হয়? যে প্রেমে তিলমাত্র আত্মরতির গন্ধ নেই, আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা নেই….সে প্রেমে অভিমান সম্ভব? কোন মানের বশে এ অভিমান? সে মানও কী সেই…তাঁর প্রিয়তমের দেওয়া মান….

জ্ঞানদাস উঠে খোলা মাঠে এসে দাঁড়ালো। বসল আল ঘেঁষে। জগতসংসার নিত্যকাজে ব্যস্ত। এ সংসারে কারুর যেন তাকে প্রয়োজন নেই। সেও যেন সব কিছু থেকে সরে সরে। এই ঠিক হয় সব। মনে হয় এই তো সব চলছে স্বাভাবিক। আবার কোথা থেকে কী হয়, পদের পর পদ গেয়ে চলে। সব কি লেখা যায়? সব কি গাওয়া যায় বাইরে? কিছু পদ আছে শুধু তার ইষ্টের জন্যেই বাঁধা। নিজের হৃদয়কেও তখন মনে হয় চোর। ভরসা হয় না। উদ্বেগ জাগে। ইষ্টের ভোগরাগে নিজের হৃদয় যেন ভাগ না বসায়! এঁটো না করে!

এ অভিমান কী তবে? অভিমান ধরে, ছাড়ে, না বাঁধে?

“যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল”....

একটা পাখি বারবার উড়ে আকাশের দিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে ফিরে বাঁশঝাড়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানদাস উদাস চোখে তাকিয়ে। দেখার উপর ভাবের আড়াল। কী সে আড়াল?

“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর”

অভিমানের উত্তর কোনোদিন পাওয়া হবে না। এ আক্ষেপ আমরণ থাকবে জ্ঞানদাস বুঝেছে। জন্মমৃত্যু কালচক্র বোঝা যায়। কিন্তু হৃদয়ের অন্তঃস্থলের রহস্য?

জ্ঞানদাস মাঠে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে। শ্রীগোবিন্দ দুর্বোধ্য নন। শ্রীরাধাই পরম রহস্য। এ গোটা সংসারে যা কিছু সব শ্রীগোবিন্দ। কিন্তু তাতে কী? সব কিছু থেকেও যদি হৃদয় না থাকে তবে সব কিছু অনন্ত হলেই বা কি? এ অসীম সৃষ্টির এত বড় ব্যর্থতা সয়? সয় না। তাই শ্রীগোবিন্দের প্রেমময় শক্তি নিয়ে জন্মায় অভিমান জাগা মাধুরী। শ্রীরাধা। অস্তিত্বের মাধুর্যের অভিমান। মাধুরী। তুলসীমঞ্জরীর সুবাস।

( ছবি - গুগুল)