Skip to main content
maa

সন্ধ্যে হব হব, ঈশ্বরগুপ্ত সেতুর উপর দাঁড়িয়ে, শ্রাবণের আকাশ তখন বারবার ওয়ালপেপার সেট করতে ব্যস্ত। কোনোটাই যেন মনের মত হচ্ছে না। হঠাৎ এক ঢেউ খেলানো কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল লাল টকটকে সূর্য। আনমনা হলাম। মনে হল যে মা দাঁড়িয়ে সামনে। কালো ঘন মাথা ভর্তি চুলের ঠিক নীচে লাল টকটকে সিঁদুর।

হাঁটতে শুরু করলাম। ওই যে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের চূড়া, হংসেশ্বরী মন্দির। চূড়া তো ওই জন্যেই এত উঁচুতে থাকে, যাতে নগরের যে কোনো প্রান্ত থেকে চোখে পড়ে, দিক ঠাহর করে আসা যায়…, আমার এক বন্ধু বলল। ভালো লাগল কথাটা।

মন্দিরে ঢোকার আগে জুতো রাখার জায়গা। গলায় কণ্ঠি, হাতে লাঠি, এক মধ্যবয়েসী মহিলা বললেন, এইদিকে আসুন… ওই… ওইখানে রাখুন….

লাঠি দিয়ে জুতো রাখার জায়গা দেখাচ্ছেন, কিন্তু মন অন্যদিকে, পাশেই বাচ্চা কোলে করে এক মহিলা দাঁড়িয়ে, সঙ্গে তার পরিবারের আরো কেউ কেউ… লাঠি হাতে মহিলা বাচ্চাটাকে বলছেন, আমায় কিন্তু বিয়ে করে নিয়ে যেতে হবে দাদুভাই…. কিচ্ছু না, খালি পেট পুরে খাবার দিলেই হবে….., আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যান যান… মন্দির খোলা আছে যে…..

=======

মন্দির খোলা। মায়ের একি সাজ! কিন্তু সে কথা পরে হবে, ওদিকে ভিড়, কি হচ্ছে?

একজন মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় একটা থালা থেকে প্রসাদ দিচ্ছেন সবাইকে। আমি গেছি একদম শেষে। থালায় পড়ে এক কণা লুচি আর নাড়ুর এক ছোট্টো কণা…. হাতে তুলে দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, দেরি করে এলেন।

আমিও হাসলাম। কি বলি? তবু তো কিছু পেলাম! একেবারে শূন্য হাতে তো ফিরলাম না।

এক বাচ্চা মেয়ে, পা দুটো ছড়িয়ে, ফোনে দাদুর সঙ্গে গল্প করছে…., জানো দাদু… মন্দিরে এসেছি…. মা-বাপির সঙ্গে…. বাইকে…. মালা পরেছি... মাথায়…. দেখবে?

তার মাথায় লাল লাল ফুল দেওয়া গোল রিং একটা…. দাদু ভিডিও কলে দেখছে…. নাতনি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাদুকে দেখাচ্ছে…. কি তার আনন্দ… কি তার হাসি!

খানিক দূরে এক বাচ্চা ছেলে বাবা-মায়ের পাশে বসে বেড়ালের মাথায় হাত বোলাচ্ছে। বাবা-মা আলোচনায় মশগুল। সে বেড়ালে মশগুল। বেড়াল তার আদরে। চারদিকে থিকথিক করছে মানুষ। এখনি মন্দির বন্ধ হবে। একে একে দোকান সব বন্ধ হচ্ছে। পুজোর ডালা, বেলুন, সাজের সামগ্রী --- সব গোটানো হচ্ছে। মাথার উপর আধখানা চাঁদ, মেঘের পাতলা চাদরে ঢাকা।

আবার মায়ের মূর্তির সামনে দাঁড়ালাম। এই যে চারদিকে শয়ে শয়ে সাধারণ মানুষ…. মা তাঁর আটপৌরে সাজে সবার মধ্যে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে যেতে লাগলেন। প্রসাদের ক্ষুদ্র কণার মত হয়ে। সাধারণ মানুষই তো সব! একবার এক যুবতী ছাত্রী নোম চোমস্কিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি যখন বৃদ্ধা হব… আমি যখন আমার নাতি বা নাতনির হাত ধরে হাঁটব… তখন যেন মনে না হয় এই অসুস্থ পৃথিবীটার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি…. আমি কি করতে পারি? আমি তো সাধারণ মানুষ একজন…. অতি সামান্য…

নোম চোমস্কি বলেছিলেন, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত, দৃঢ়স্বরে বলেছিলেন, আজ অবধি যা পরিবর্তন হয়েছে তা সাধারণ মানুষ জেগেছে বলেই হয়েছে…. মার্টিন লুথার কিং অবশ্যই বড় মানুষ… কিন্তু শয়ে শয়ে মানুষ তাঁর ডাকে সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই পরিবর্তন এসেছে….. সব সাধারণ মানুষের জন্যেই তো…..

অন্ধকার নেমে এসেছে গঙ্গার উপর। ঈশ্বরগুপ্ত সেতু পার হচ্ছি….. চারদিকে অসংখ্য মানুষ… সাধারণ মানুষ…. একবার আলোর দিকে ফিরলে…. একবার জেগে উঠলে….. সব আবর্জনা ধুয়েমুছে পরিষ্কার….. কালবৈশাখীর ঝড়ের বাতাসও তো এই সাধারণ বাতাসের ঘুর্ণীতেই তৈরি….. আমরা শুধু জানি না কবে সে ক্ষণ আসবে…. কিভাবে আসবে…. যে জানে… সে কি মহামানব….? "ওই মহামানব আসে….", সে কি কেউ একজন… নাকি গর্জে ওঠে ওই প্রসাদের কণিকার মত সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই কেউ….. যে বলে ওঠে আর সহ্য করব না…. অনেক অনেক হয়েছে!......

 

(ছবি: Debasish Bose)

 

Category