কিছু কী পার্থক্য ছিল রে?
না রে…. শুধু বাইরেই ছিল….
দুজন বন্ধু। দুজনেই ষাট পেরিয়েছে। একজন ফুচকা বিক্রি করেছে আজীবন। স্টেশান থেকে নেমেই অটো স্ট্যাণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে। স্কুলের পরে আর কলেজ যায়নি।
আরেকজন সেই স্টেশানের রাস্তায়, তার পাশ দিয়েই কলেজ গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় গেছে। চাকরির জন্য এদিক ওদিক গেছে। চাকরি করতে গেছে মাঝারি পদ থেকে উচ্চপদে। অবসরপ্রাপ্ত হয়েছে।
যে ফুচকা বিক্রি করত তার সঙ্গে বন্ধুত্বে ছেদ হয়নি একদিনও। একে অন্যের বিয়েতে গেছে। একে অন্যের ছেলেমেয়েদের অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, বিয়েতে গেছে। অসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
যে ফুচকা বিক্রি করত, সে এই মুহূর্তে আইসিইউ এর তিন নাম্বার বেডে শুয়ে। লিভার ক্যান্সারের কালিতে তার জীবনের শেষ অধ্যায় লেখা হচ্ছে। আর মাত্র কয়েকটা পাতা বাকি। তার পাশে বসে আছে তার আজীবনের বন্ধু। হাতটা ধরে। এই মুহূর্তের প্রতিটা ক্ষণের আয়নায় পেরিয়ে আসা গোটা জীবনের টুকরো টুকরো ছবি ফুটে উঠছে। এলোমেলো।
“কোথাও কিছু পার্থক্য ছিল না বল….” কত দশকের ফুচকা মাখা হাতটা চাইল শক্ত করে ধরতে বন্ধুর হাতটা। কিন্তু অত জোর কোথায়? সব জোর কেড়ে নেবে। তবে তো সে আসবে!
“না রে….পার্থক্য কেন থাকবে….আমি তো আমি…তুই তুই-ই”।
সে ঘুমিয়ে পড়ল। নার্স ইশারা করল। সে জানত এই শেষ দেখা। সে বাইরে এসে রেলস্টেশানের দিকে হাঁটল। তার বন্ধুর ফুচকার জায়গাটা ফাঁকা। গোল দাগ হয়ে আছে। এতদিনের অভ্যাস! এ দাগটা মুছে যাবে, নইলে অন্য কেউ বসাবে নতুন দোকান।
স্টেশানে বসে। রাত এগারোটা। ইচ্ছা করছে না বাড়ি যায়। এ শহর সেই পুরোনো শহর। শহরটা কি সত্যিই পুরোনো হল? চারদিকে কত নতুন নতুন মানুষ। তারও যাওয়ার সময় হল। ও যাক। শান্তিতে যাক। মৃত্যুতে বিস্ময় লাগার বয়েস নেই আর। তবে জীবনকে ঘিরে বিস্ময় শেষ হল না। আজীবন বাইরের ঘরে বসেই যেন সবটুকু আয়ু কেটে গেল, ভিতরের ডাকের অপেক্ষায়। কেউ ডাকল না।
প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে এসে দাঁড়ালো। জগদ্ধাত্রী পুজো হয় এখানে। প্যাণ্ডেল ফাঁকা। মা একা দাঁড়িয়ে প্যাণ্ডেলে। মা, কী করলাম আজীবন? কী চেয়েছিলাম আসলে? কী পেলে সব ফাঁক, সব শূন্যতা ভরে যেত?
ফোন বাজল। পকেট থেকে ফোনটা বার করল। নামটা দেখেই বুঝল। আর নেই ও। ফোনটা ধরল না।
মায়ের কাছে বসল। বলল, মা একটা গ্যাস বেলুন কিনে দাও….মা দু মুঠো ভরে বাতাসা নকুলদানা দাও….মা ভালো একটা খেলার ব্যাট দাও….মা আমাকে সব পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দাও….মা… মা…..
মুখটা দুটো হাতে ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদছে সে। মায়ের সামনে কাঁদছে, এ কী কম কথা! মা রাতের আকাশে তারা তারা আঁচল বিছিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। কী দরদ চোখে! প্রথম বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধের মত দরদ। জগদ্ধাত্রী যে মা! আকাশ থেকে অন্ধকারের আঁচল বাড়িয়ে গোটা শরীরকে আড়াল করেছে তার। মা তো, ছেড়ে দিলে হয়!