রোজ শেষরাতে রাস্তার লাইটটা নিভে যায়। আশ্চর্য না? সামনে বড় একটা বাঁক, ওই বাঁশঝাড়টা পেরিয়েই। তারপর ডানদিকে অত গভীর একটা পুকুর। লাইটটা কি করে নেভে?
সামন্ত রবিবার সকালে ইলেকট্রিকের লোক ডাকল। সারা সপ্তাহ কলকাতা আর বাড়ি করতে করতেই কেটে যায়। সময় কোথায়? যদিও এই আলোটা পঞ্চায়েতের দেখার কথা, কিন্তু সামন্ত নিজেই দায়িত্ব নিয়ে দেখে নিতে চাইছে। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলে নিজেকে অপরাধী লাগবে। বউবাচ্চা নিয়ে সংসার, সবার আপদেবিপদে দাঁড়ানোটা কর্তব্য তো।
“না দাদা কোনো অসুবিধা নেই…. একটা কথা বলব, আমার মনে হয় কিছু চ্যাংড়ার শয়তানি…. রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় টুক্ করে সুইচটা অফ্ করে দিয়ে চলে যায়। আপনি একটু খেয়াল করে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ধরতে পারবেন।”
পল্টু কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলে গেল।
পল্টু ভালো ছেলে। কাজ ভালো শিখেছে। এক সময় পড়তেও আসত তার কাছে। রবিবার করে অঙ্ক আর ইংরেজি পড়াত সামন্ত তখন। এখন নিজের বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে, ওদের সময় দিতে হয়। তাই আর…. কিন্তু কথাটা ঠিক বলেছে ছেলেটা। ওই কুমোরপাড়ার দিকে একটা ঠেক বসেছে বটে কিছু চ্যাংড়ার। ওরাই হবে।
সোমবার রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দোতলায় সামনের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসল সামন্ত। অন্যদিন হলে এই সময়টা টিভি দেখে, কি ওয়েব সিরিজ দেখে। আজ এখানেই বসবে ঠিক করেছে। হাতেনাতে ধরবে।
রাত দুটো। ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দায় বসে। শীত শীত করছে। কখন ঘুমালো? চারদিকটা এত অন্ধকার কেন? উফ্..., ওই দেখো, আবার আলোটা অফ্ করে দিয়েছে! কি জ্বালা বলো তো!
ঘটনাক্রমে সামন্ত শুক্রবার অবধি রোজই ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে আলোও নেভানো। বাচ্চা নিয়ে বউ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। ডাক্তারে রাত জাগা নিষেধ করেছে ওকে। নার্ভের সমস্যা আছে। কিন্তু নিজেরও তো জেগে থাকা যাচ্ছে না। বরাবরই একটু ঘুমকাতুরে সামন্ত।
শনিবার সন্ধ্যায় সামন্ত দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। হরি মাছ বিক্রি করে ফিরছে, রাস্তার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওই ব্যবসাপত্তরের কথা আরকি। সামন্ত দোতলা থেকেই কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পড়ল নিজেদের দরজায় লাগানো সিসিটিভি-র ক্যামেরার দিকে। তাই তো! ওটার মুখটা দু'দিন রাস্তার ওইদিকে, মানে আলোটার দিকে ঘুরিয়ে দিলেই তো হয়!
ব্যস, পরেরদিন আবার পল্টু এলো। সিসিটিভি ক্যামেরা খুলল। দরজার দিক থেকে রাস্তার দিকে টিপ করে আলোটার দিকেই তাক করেই লাগানো হল। সামন্ত চেক করে নিল। এইবার বাছাধন যাবে কোথায়!
রাত তিনটে। সামন্ত'র ঘুম ভাঙল। যথারীতি রাস্তার আলো নেভানো। তাড়াতাড়ি মোবাইলের আলোটা জ্বেলে চেয়ারটা টেনে বসে গেল। মোবাইলটা অফ্ করে কম্পিউটার স্ক্রিণে দেখতে লাগল শেষ তিন ঘন্টার ভিডিও। কারণ বারোটা অবধি আজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনেই কথা বলেছে অরিজিতের সাথে। তার কলিগ। অফিসে একটা গোলমাল হচ্ছে সেই নিয়ে কথা হচ্ছিল।
রেকর্ডিং চলছে। রাত একটা। রাস্তা ফাঁকা। আলোটা ঘিরে পোকাগুলো উড়ছে। একটা কুকুর গেল। ওই কালো ঘেয়ো কুকুরটা। কেউ নেই রাস্তায়। একটা অজানা উত্তেজনায় বুকটা কাঁপছে। খাটের থেকে নয়নার নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। শীতটা আছে বেশ এখনও। চাদরটা নিয়ে বসলে ভালো হত। মেঝেতে পা'টাও রাখলে কনকন করছে। পাপোশটা খাটের সামনে। একি!
ঠিক একটা চল্লিশে আলোটা অফ্ হয়ে গেল। সব অন্ধকার।
হঠাৎ সামন্ত'র মনে হল, পিঠে হাত রাখল কেউ। নয়নার নাক ডাকার শব্দ আসছে খাট থেকে। চমকেই উঠল। তবে কে?
পিছন ফিরে তাকাতে সারা শরীর অবশ হয়ে গেল সামন্ত'র। পাঁচু। ইলেক্ট্রিকেরই কাজ করত পল্টুর মত। এই সামনের পুকুরে ডুবেই মারা যায়। লোকে বলে খুন করা হয়েছিল।
পাঁচু কানের কাছে মুখ এনে বলল, “অপেক্ষা করছি ওদের। একদিন না একদিন এ রাস্তায় আসবে। প্রতিশোধ নেব। ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে দিও কাল।”
ভোরবেলা নয়না ঘুম থেকে উঠে, ঠাকুর প্রণাম করে বিছানা থেকে নেবে বলল, একি, এখানে বসে আছ কেন? আর ঘরে এত জল এলো কি করে!