লক্ষ্মীকান্ত বারের ঠাকুরের পুজোর দিন মদ ছোঁয় না। রিকশাটা স্ট্যাণ্ডে রেখে বারের ঠাকুরের মন্দিরের সামনেই বসে আছে। আজ ভাড়া নেবে না। নীল হাফপ্যান্ট আর সবুজ টিশার্ট পরে উবু হয়ে পরেশ ঠাকুরের পুজো করা দেখছে। পরেশ ঠাকুরের হার্টের বড় অপারেশন হয়েছে পুজোর সময়। মানুষটা দরদর করে ঘামছে। পাখা চালানো যাবে না। প্রদীপ নিভে যাবে।
বিজয়ার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে আশা নেই। বিজয়া বলে বাবা যেদিন এই নোংরা লাইনে বিক্রি করে গেল সেদিন থেকেই তো আশা ছিল না। তাও তো এই বিয়াল্লিশটা বছর কাটিয়ে দিলাম। নষ্ট মেয়েমানুষ হলে কী হবে, ভগবান একদম কাঙাল তো করেনি। তুমি আসো নাহলে আমার জীবনে?
বিজয়া তার বুকের উপর মাথাটা রেখে বলেছিল। একবার না, অনেকবার বলেছে। খোলা চুল লক্ষ্মীকান্তের বুক বেয়ে খাটে এসে পড়েছে। লক্ষ্মীকান্ত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মায়ের কথা মনে পড়েছে। মায়ের জীবনেও তো কত কেউ ছিল। না থাকলে বাঁচত তার মা? পাঁচিল একটা হলে ঘরকে আটকানো যায় না, তার দিদা বলত। চারটে পাঁচিল, একটা ছাদ লাগে। হরিশ সর্দার, মায়ের ছাদ। তার বাবা। খুন হয়ে গেল। পাঁচিলও বদলালো কতবার!
আরতি হচ্ছে। লক্ষ্মী উঠে দাঁড়ালো। বিজয়া প্রসাদ নিয়ে যেতে বলেছে। সিন্নি নিয়ে যাবে। ছোটো একটা টিফিনবাক্স নিয়ে এসেছে। পরেশ ঠাকুর বলল, এসো শান্তির জল নিয়ে যাও। পরেশ ঠাকুর একটা ছোটো তামার পাত্র নিয়ে দাঁড়ালো। হাঁপাচ্ছে মানুষটা। লক্ষ্মী মাথাটা নীচু করে হাঁটুমুড়ে রাস্তাতেই বসল। অনেকে বসেছে। শান্তি কে না চায়? শান্তি তো গ্যাসবেলুন। ছোটোবেলায় বাবা কিনে দিত। বলত ধরে রাখবি। কিন্তু একদিনও ধরে রাখেনি লক্ষ্মী। উড়িয়ে দিয়েছে। হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছে। যেবার প্রথম পুরী যাচ্ছিল, হাওড়া ব্রীজের মাথার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। দিদা বলত সব বেলুন নাকি এই ব্রীজের মাথায় আটকে আছে। কই? নেই তো। সবাই মিথ্যাকথা বলতে জানে। সেও জানে। দিদার টাকার ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশোটাকার নোট চুরি করে এনেছে। দিদা জানতে পারবে। বলবে না কিছু। যে কথাটা ভাবছিল, শান্তি গ্যাসবেলুনের মত। সবাই ধরে রাখতে চায়, কিন্তু উড়িয়েই দেয়। কেন দেয় সে নিজেও জানে না।
মোবাইলটা বাজল। পকেট থেকে বার করে ঝুঁকে দেখল, যাতে শান্তির জল মোবাইলে না পড়ে। বিজয়া লিখেছে, মাল এনো। বড্ড মালের তেষ্টা পাচ্ছে। পরেশ ঠাকুরের শান্তির জল বারের ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে মাথায় পড়ল।
======
সিন্নি আর মদের বোতল নিয়ে ঢুকে দেখে বিজয়া ঘুমাচ্ছে। তাকে একটা কোনায় ঘর দিয়েছে এ পাড়ায়। এ ঘরে কাস্টমার আসে না।
মাথার কাছে বসল লক্ষ্মীকান্ত। বিজয়াকে ডাকল, উঠবে?
বিজয়া উঠল। লক্ষ্মী আলো জ্বালতে উঠল। বিজয়া হাতটা ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, পরে। আমাকে একটা চুমু খাও। তোমার সেই ফেভিকুইক চুমু।
লক্ষ্মী পারল না আগের মত চুমু খেতে। পচা গন্ধ বিজয়ার মুখে। ডাক্তার বলেছে সব পচে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
বিজয়া বলল, আমার মরতে কত দেরি বলছে গো ডাক্তার?
লক্ষ্মী বলল, সিন্নি এনেছি।
বিজয়া বলল, মাল?
লক্ষ্মী বলল, আগে সিন্নি।
বিজয়া বলল, আগে মাল….তবে তোমার ঠাকুরের প্রসাদ রুচবে….নইলে বমি হয়ে বেরিয়ে যাবে…..
লক্ষ্মী গ্লাসে মদ ঢালল। বিজয়ার হাতে দিল। বিজয়া হেসে বলল, তুমি তো ছোঁবে না আজ। বিজয়া গলায় ঢেলে বলল, এক চামচ সিন্নি দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে চলে যাও তুমি। কাল এসো। আমি ঘুমাই একটু।
লক্ষ্মীর ক্লান্তি লাগছিল। বিজয়ার থেকে দূরে গেলেই যেন ভালো লাগবে। গঙ্গার ধারে যাবে? ফেরার সময় একবার দেখে যাবে।
গঙ্গার ধারে ঘন্টা তিনেক কেটে গেল ঘুমিয়ে। আরো যেত হয় তো, চীৎকারে ঘুম ভাঙল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বস্তির দিকে। লক্ষ্মীর সারাটা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মোবাইলটা বার করে দেখল, ক'টা বাজে। বারোটা পঞ্চান্ন।
একটা মেসেজ আছে, বিজয়ার।
“নিজেকেই পুড়িয়ে গেলাম লক্ষ্মী, আবার কার জন্য ফেলে রাখব এ পোকায় খাওয়া গতরকে? এ নষ্ট মাগীর ঝক্কি পোয়াবে কে? তোমার আনা মালেই আমার সব শান্তি হল লক্ষ্মী। পারলে মদটা ছেড়ো।”
লক্ষ্মী সারারাত বসেছিল গঙ্গার ধারে। অপরাধী লাগছিল। শেষ চুমুটায় ফাঁকি ছিল। ঘেন্না ছিল। ছি!