আজ মাতৃভাষা দিবস। আজ আমার গল্প করতে ইচ্ছা করছে ওমপ্রকাশ বাল্মীকিকে নিয়ে। আয়ুষ্কাল ছিল ১৯৫০ থেকে ২০১৩ সাল। জন্ম উত্তর প্রদেশের এক দলিত বস্তিতে। মৃত্যু দেরাদুনে, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, এবং সর্বোপরি এক বিখ্যাত লেখক, নাট্যকার, কবি হয়ে।
আজ কেন বাল্মীকিকে নিয়ে গল্প করতে ইচ্ছা করছে? কারণ, ওর মরণপণ নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা। সেই ভাষাকেই অস্ত্র করে দলিতদের হয়ে লড়াই করা। নিজের ভাষার আলোতেই বিশ্বকে চিনতে চাওয়া। নিজেকে আবিষ্কার করা।
কিন্তু এত অল্প পরিসরে এতবড় জীবনকে লেখা সম্ভব?
ঠিক আছে শুরু তো করি। আসলে আমি ঠিক জীবনী লিখতে চাইছি না, ওমপ্রকাশের সঙ্গে ওর ভাষার নাড়ির যোগটা বলতে চাইছি। আমি এখন থেকে ওমপ্রকাশ না বলে, ওর ভীষণ গর্বের উপাধি “বাল্মীকি”-ই বলব। যখন উনি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, কিন্তু দলিত বলে নানা জায়গা থেকে নানাভাবে অপমানিত, বঞ্চিত হচ্ছেন, তখন অনেকে ওকে বলে, আপনি আপনার এই বাল্মীকি উপাধিটা ত্যাগ করুন না। কি দরকার সবাইকে জানিয়ে আপনি দলিত। কিন্তু ওমপ্রকাশ কোনোদিন সে মিথ্যার আশ্রয় নেননি। তিনি হাজার অপমান সহ্য করেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু নিজের সত্য পরিচয় গোপন করেননি।
======
বাল্মীকি জন্মালেন বস্তিতে। কবির মন নিয়ে। সংবেদনশীল মন নিয়ে। যে জাতপাত প্রথা, যে অচ্ছুৎ হয়ে থাকাকে আশেপাশে সবাই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল, বাল্মীকির তা মানতে অসুবিধাই হল। চারদিকে শুয়োরের পায়খানা, জমাজল, কাদা, নোংরা, দুর্গন্ধ। ওরই মধ্যে মানুষ জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, বিয়ে হচ্ছে, তাদের বাচ্চা হচ্ছে, উৎসব-পার্বণ হচ্ছে, অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। সবই ওই নারকীয় পরিবেশে। জাত, “চুহড়”। কোথাও পশু মরলে তার ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়, কোথায় কোন দেবীর পুজোয় শুয়োর বলি দিতে হয়, তাই বাড়িতে শুয়োর পালন করতে হয়, আবার সেই সব উচ্চবর্ণের বাড়িতে গিয়ে তাদের বলি দিতে হয়। সেই বাচ্চা শুয়োরের রক্তে দেবীর পুজো হয়। কিন্তু তাদের জাতের কাজ ওই বলি দেওয়া অবধি। তাদের জাতের দেবদেবী নিজস্ব। মদ আর শুয়োরের মাংসে পুজো হয়। কেউ অসুস্থ হলে প্রথমে টোটকা। আরো বেশি হলে বিশেষ মানুষদের আনা হয়, যাদের উপর দেবতার ভর পড়ে। মানে দলিতদের দেবতার। সে বিধান দেয়। মানুষগুলো বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
এরকম একটা পরিবেশে বাল্মীকি জন্মালেন। বাবা চাইলেন ছেলে পড়ুক। প্রথমে একটা অস্থায়ী পাঠশালায় পাঠ শুরু হল, কিন্তু তারপর সে সব উঠে গেল। কদিন পর সরকার থেকে প্রাথমিক স্কুল খোলা হল। অনেককে বলে কয়ে সে স্কুলে ভর্তি হলেন বাল্মীকি। কিন্তু ক্লাসে বসা যাবে না। একটা কোণে নিজের বাড়ি থেকে আনা চট পেতে বসতে হবে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে মরে গেলেও কেউ জল দেবে না। তার উপর অনেক শিক্ষকের চক্ষুশূল হলেন, দলিত হয়ে অক্ষরজ্ঞান! যাও, ক্লাস করতে হবে না, সারা দুপুর মাঠ পরিষ্কার করো, পায়খানা পরিষ্কার করো।
একদিন বাল্মীকির বাবার চোখে পড়ল, ছেলে ক্লাসে না বসে মাঠ ঝাঁট দিচ্ছে। ব্যস, বাবার মাথায় আগুন খেলে গেল। অনেক তাণ্ডব হল। শেষে গিয়ে পড়াশোনা শুরু হল। শারীরিক, মানসিক, আত্মিক নিপীড়ন চলতেই থাকল। সে সবের বর্ণনা পাতার পর পাতা লিখে গেছেন বাল্মীকি। সঙ্গে স্কুলের লাইব্রেরি থেকে পাচ্ছেন প্রেমচাঁদ, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের বই। পড়ছেন। ওই বস্তিতে বসেই পড়ছেন। যে বস্তিতে একটু বেশি বর্ষায় মাটির দেওয়াল ধসে যায় বাড়ির, চাল ভেঙে পড়ে। চারদিকে যেখানে মারামারি, অশ্রাব্য গালাগাল, মাতলামি চলছেই সেখানে বসে কিশোর বাল্মীকি পড়ছে শরৎচন্দ্র। মাকে শোনাচ্ছেন। মা উনুনে ঘুঁটে আর কাঠের আঁচের সামনে বসে বসে শুনছেন। মা আর ছেলে দুজনেরই চোখ ভিজে আসছে। কি অপূর্ব বর্ণনা করেছেন বাল্মীকি।
======
ক্রমে বড় স্কুলে গেলেন। কিন্তু অপমান পিছন ছাড়ল না। নিজেদের গ্রাম থেকে বেশ কিছুদূরের একটা গ্রামে গিয়েছিলেন। মাষ্টারের পরিবারের কাছে। সঙ্গে বন্ধু। সাইকেলে চড়ে গেলেন। তারা খেতে দিল। কিন্তু তখনও জানত না তারা দলিত। যখন জানল মারতে মারতে বার করে দিল। দুজন সাইকেল চড়ে অতটা ত্রাস নিয়ে। অতটা অপমান নিয়ে। লাঞ্ছনা নিয়ে। রাস্তায় গরুর গাড়ির সঙ্গে সাইকেলে ধাক্কা লাগল। সাইকেল গেল তুবড়ে। টানতে টানতে সে সাইকেল নিয়ে পৌঁছালো এক সাইকেলের দোকানে। সাইকেল সারানো হল। কিন্তু একটাও পয়সা নেই। যাবে কিভাবে এত রাতে? হঠাৎ মনে পড়ল এই সামনের বাস স্ট্যাণ্ডে এক পূর্ব পরিচিত শিক্ষক আছেন। ক্লার্কের কাজ করেন এখানে এখন।
তাকে পাওয়া গেল। একজনের মাত্র ব্যবস্থা উনি এই এত রাতে শেষ বাসে করতে পারবেন, কিন্তু বাকিটা রাত আরেকজনকে এখানে কাটিয়ে ভোরের বাসে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন জানালেন।
তাই হল। বন্ধু সাইকেল বাসের মাথার উপর উঠিয়ে চলে গেল। বাল্মীকি থেকে গেল। কিন্তু রাতটা কাটাবে কোথায়?
সেই শিক্ষক তাকে একটা রুটি আর চা খাওয়ালেন। তারপর নিজের শোয়ার জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, রাতটা এখানেই কাটিয়ে দে।
আর রাত! দেড়টা নাগাদ দরজায় খটখট। এক নারীকে নিয়ে এক পুরুষ দাঁড়িয়ে। কি কথা হল দুই পরিণত বয়স্ক পুরুষে কানাকানিতে, একটু পর শিক্ষক এসে বললেন, চল, তুই আমি বাইরে শোবো।
বাল্মীকি বাইরে এসে শুলো। এক আকাশ তারার নীচে। ঘরের ভিতর থেকে মহিলা কণ্ঠের অদ্ভুত আওয়াজ। কিশোর বাল্মীকি লিখছেন একটু পর সে পুরুষ বেরিয়ে এলো। শিক্ষক গিয়ে ঢুকল ঘরে। আবার সেই এক আওয়াজ। মড়ার মত পড়ে আছে বাল্মীকি। বুঝতে দেওয়া যাবে না সে জেগে আছে।
খানিকবাদে স্যার বেরোলো। দুজনে গল্প হচ্ছে। সেই আগন্তুক পুরুষ হাসতে হাসতে বলছে, বলেছিলাম না খাসা মাল…. এই বাচ্চাটাকেও পাঠিয়ে দে, চেখে আসুক!
বাল্মীকির মনে এ ঘটনা তীব্র হয়ে বেজেছিল। এরকম বহু অপমান বাল্মীকির মনে সুকঠোর হয়ে বেজেছিল। বাল্মীকি সে সবকে জমিয়ে জমিয়ে বড় হচ্ছিল। যা পরে তার নানা লেখায় ভাষার শরীর নেবে।
======
বাল্মীকির কলেজ আসার আগে বাল্মীকির এক বিধবা বৌদির কথা বলে নিই। বাল্মীকির পড়া যখন প্রায় থেমে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল সেই শুরুর দিনগুলোতে, সেই বৌদি নিজের স্বল্প কিছু সঞ্চয় শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, মা, ওর পড়া যেন বন্ধ না হয় দেখো।
নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে এক পাষণ্ড উচ্চবর্ণের মানুষ আর নিজের অলস পাষণ্ড কাকার জন্য ওই কিশোর বয়সে বাল্মীকিকে, যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছে, যে শরৎচন্দ্রের লেখা পড়ে কাঁদছে, তাকে মৃত গরুর ছাল ছাড়াতে হয়েছিল একা। ফিরে মাকে জড়িয়ে ভীষণ কেঁদে কেঁদে বলেছিল, মা, আমাকে এ কাজে আর পাঠাস না রে। মা কেঁদেছিল। বৌদি কেঁদেছিল। দুজনেই বাড়িতে তুমুল অশান্তি করে বলেছিল, বাল্মীকিকে কেউ ওইসব কাজে আর পাঠাবে না। তাতে যদি আমাদের চূলা না জ্বলে, তো না জ্বলবে!
এরকম কত মা, কত দিদি, কত বোন, কত বৌদির গল্প আমরা জানি না, সে ঈশ্বরই জানেন। সবাই তো বাল্মীকির মত লেখেন না।
বাল্মীকি কলেজে এসে প্রথম আম্বেদকরের বই হাতে পান। ব্যস, চারদিকে সব বদলে যেতে শুরু করল বাল্মীকির। কই এতদিন তো এই মানুষটার নাম কেউ বলেনি! বাল্মীকির ভিতরে যে সত্তা ভাষাকে ভালোবেসেছিল এতদিন, সে এবার তার নিজস্ব গতিপথ পেল। সে বুঝল তাকে কি লিখতে হবে। কিন্তু লেখার আগে নিজের চিন্তাকে তো সাজাতে হবে। শুরু হল গোগ্রাসে পড়া। তর্ক। আলোচনা। সঙ্গে নানারকম শোষণ, পীড়নের সম্মুখীন হওয়া। এমনকি বিজ্ঞানবিভাগের অধ্যাপকদেরও তার জাত নিয়ে অসুবিধা। তার হাতের জল খেতে অসুবিধা। তাকে নীচ দেখানোর, ছোটো দেখানোর চেষ্টা সেখানেও। তবে এই বাল্মীকি বদলে যাওয়া বাল্মীকি। বাল্মীকি যা শিখছে, তা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নিজের গরজ করে পাওয়া শিক্ষা। তাকে সে বহন করবে না, বাহন করবে। করলও তাই।
=======
এর মধ্যে বাল্মীকির জীবনে দুটো বড় পরিবর্তন হল। এক, পড়াশোনা মাঝপথে থামিয়ে দেরাদুনে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে অ্যাপ্রেনটিস হয়ে জয়েন করা, দুই, পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে নিজের চিন্তাধারার পার্থক্য তৈরি হওয়া।
অ্যাপ্রেনটিস হওয়াতে আর্থিকভাবে সচ্ছল হল বাল্মীকি। স্কুলে, কলেজে নিজের পোশাক নিয়ে কম লাঞ্ছিত তো হতে হয়নি! কিন্তু ঘরে বাইরে কি ভীষণ লড়াইয়ের সামনে এসে পড়ল বাল্মীকি। মেধা যে উচ্চতায় ওড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে তাকে, যেখানে মানুষের চিন্তার, ভাবের যে উৎকর্ষতা, স্বাধীনতা, মর্যাদাবোধের সঙ্গে তার পরিচয় হচ্ছে, তার সঙ্গে তার আত্মার ভাষা মেলে। কিন্তু বাইরের মানুষের আঘাত তো আছেই। কিন্তু তার নিজের “জাত” এর মানুষদের মেরুদণ্ডহীন মানসিকতা? আর মেরুদণ্ডেরই বা দোষ কি? শতাব্দীর পর শতাব্দী অত্যাচারিত হতে হতে তারা ভুলেই গেছে নিজেদের মনুষ্যত্বের কথা। ভুলেই গেছে প্রাথমিক অধিকারগুলোর কথা।
বাল্মীকির লেখা ক্রমে ধারালো হতে শুরু করল। কিন্তু সে স্বল্প পরিসরে প্রচারিত। এর মধ্যে বাল্মীকি জব্বলপুর হয়ে মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত। বিয়ে হয়ে গেছে। সঙ্গে চলছে লেখালেখি। দলিতদের নিয়ে পত্রিকায় লেখা বেরোচ্ছে। প্রায় ভারতের সব জায়গা থেকে। অনেকে বলছেন, তুমি তোমার এই প্রবল সাহিত্য প্রতিভা শুধু দলিত সাহিত্য লিখে নষ্ট করবে? এমনকি যখন এই আত্মজীবনী “ঝুঠন” লিখছেন, তখনও অনেকে বলেছেন, একি করছেন, আপনাকে কবি হিসাবে সারা দেশ এত সম্মান করে, আপনি এইসব লিখলে আপনি প্রতিষ্ঠা হারাতে পারেন!
বাল্মীকি শোনেননি। আসলে “টলারেন্স” শব্দটাকে আমি আবার নতুন করে শিখতে শুরু করলাম বাল্মীকিকে পড়তে গিয়ে। যখন ফাইনালি দেরাদুনে উচ্চপদে ট্রান্সফারড হয়ে গেলেন, এক মাসের উপর লাগল মাথা গোঁজায় জায়গা পেতে। শ্বশুরবাড়ির দুটো ছোটো ঘরে কাটাতে হয়েছিল সে ক'টা দিন। আর মুম্বাই থেকে আসা সব আসবাবপত্র বাক্সবন্দী হয়ে স্টেশানে। এক একটা বাড়িতে বাড়িওয়ালার কাছে নিত্যনতুন অপমান। কি শান্তভাবে সহ্য করেছেন বাল্মীকি। কিন্তু সে আগুন ভাষা পেয়েছে লেখনীতে।
একটা ঘটনা। একবার অফিসে যাচ্ছেন, দেখেন একটা জায়গায় বেশ কিছু মানুষের ভিড়। কি হয়েছে? জানলেন, গতকাল রাতের বৃষ্টিতে এই মাটি ধসে চাপা পড়ে মারা গেছে কিছু শ্রমিক। ওই যে লাশ বিছানো রাস্তার ধারে। উন্মুক্ত। মাছি বসছে মুখে। কারা ওরা? আরে ওই যে হস্টেল বানানো হচ্ছিল না, তাদের অফিসেরই তো। সেই ঠিকাদারের লোকজন, কয়েকটা অস্থায়ী ঝুপড়ি বানিয়ে ছিল ওই মাটির ঢিবির উপর। ওরাই।
পুলিশ নেই। কোনো আধিকারিক নেই। গেলেন থানায়। তারা জানালো বড়বাবু না এলে তাদের কিছু করার নেই। তবু অনুরোধ উপরোধে তারা লাশগুলো অন্তত সরানোর ব্যবস্থা করল। অফিসে গেলেন। বাম, ডান শ্রমিক সংগঠন বলল, ওরা তো বাইরের, ঠিকাদারের। আমাদের কি?
পরেরদিন কাগজে বেরোলো, বৃষ্টিতে অনেক ভবঘুরে ওই ঝুপড়িগুলোতে আস্তানা গেড়েছিল। মরেছে ওরাই।
বাল্মীকির অসহায় যন্ত্রণা ফেটে পড়ল কবিতায়। ছাব্বিশে জানুয়ারি পাঠ করলেন অফিসের অনুষ্ঠানে। শ্রমিকরা দাঁড়িয়ে হাত তালি দিল। বাল্মীকি অনুভব করলেন তবে এ যন্ত্রণা এতগুলো মানুষের মধ্যেও চাপা ছিল! ভাষা জুড়ে দিল সেতু!
এরপর বাল্মীকির শ্রমিকদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হল অনেক জায়গায়। অফিস থেকে নানা ষড়যন্ত্র হল। এমনকি বাল্মীকির বই যাতে ছাপতে না পারে সে ষড়যন্ত্রও হল। কিন্তু বাল্মীকির জেদের কাছে, আত্মবিশ্বাসের কাছে সব খুড়কুটোর মত ভেসে গেল। এনসিআরটির সিলেবাসে বাল্মীকির লেখা ছাপা হল। সেই নিয়ে তাণ্ডব হল সংসদে। বাল্মীকি তবু থামলেন না।
======
এই হল বাল্মীকির গল্প। আরো অনেক অনেক কথা লেখা হল না। বাল্মীকির আর ওঁর স্ত্রীর প্রায় ছুটির দিনগুলো দলিত বস্তিতে কাটানোর কথা, তাদের সুখদুঃখের কথা শোনা। মাটির ভাষার কাছাকাছি থাকার প্রয়াসের কথা। চেয়েছিলেন এক শান্ত পরিবেশ, যেখানে বসে নিজের সাহিত্য সাধনা করে যেতে পারবেন। আরো আরো কথা যা বলা হল না, প্রখ্যাত মানুষদের সঙ্গে ওঁর আলাপ আলোচনার কথা। এখানে উল্লেখ্য, ওঁর বিখ্যাত লেখা, আত্মজীবনী 'ঝুঠন' এর দ্বিতীয়ভাগ ওঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
এ জীবন ছিল ভাষার সঙ্গে পথ চলার গল্প। নিজেকে আবিস্কারের গল্প ভাষা দিয়ে। মাতৃভাষা দিয়ে। কিন্তু মাতৃভাষা মানে কি শুধুই অক্ষর? যে ভাষায় আমি আমার প্রাণের আলো পাই, সে সবই আমার মায়ের ভাষা। আমার অক্ষরে সেগুলোকে আত্মীয় করে তোলা আমার দায়িত্ব। মহা দায়িত্ব। বাল্মীকি অবশেষে দলিত সাহিত্যিক হয়ে রয়ে গেলেন, এ আমাদের দুর্ভাগ্য। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। আজ সে কথা থাক। আজ বাল্মীকির সেই আত্মবিশ্বাস, মর্যাদাবোধের প্রকাশ নিজের ভাষায়, সেই কথাই স্মরণে আনি। আমার প্রণাম জানাই।
ভাষা সেতু। পুরাণে যেমন আছে, নিরাকার ব্রহ্ম মানুষের শরীর ধারণ করে, তেমনই নিরাকার হাজার ভাব ভাষার শরীর ধারণ করে কি যাদুতে, সে এক বিস্ময়। নোম চমস্কি বলেন, এই একটা জায়গায় মানুষের বিস্ময়। মাত্র কটা শব্দ আর সংখ্যা দিয়ে এতবড় বিশ্বের এত এত রহস্যকে সে কি করে অনুবাদ করে ফেলছে? বুঝে ফেলছে!
এ আমরা কোনোদিন বুঝব কিনা জানি না। তবে সেই সব মাতৃভাষায় নিবেদিত প্রাণেদের আমার শ্রদ্ধা জানাই। আর বাল্মীকির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনেই আজ আমার একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হোক।