এত ম্লান হাওড়া স্টেশান দেখব ভাবিনি কোনোদিন। হুইলারের স্টলে ঝুলছে ঝুল। একটা খবরের কাগজ পেলাম না। সব বইয়ের দোকান বন্ধ। শনিবার ছ'টা। আমাদের ট্রেন সাতটা পনেরোয়। অমৃতসর মেল। গন্তব্য, বারাণসী। কারণ, কিছুটা ব্যক্তিগত কাজ, আর কিছুটা প্রিয় শহরটার খোঁজ নিতে।
পৌঁছালাম। একি ভিড়! কারোর মুখে মাস্ক নেই! মায় মহাদেবের মন্দিরে ঢোকার জন্যেও মাস্কের দরকার নেই। শহর আগের থেকে পরিষ্কার। ঘাট আগের থেকে পরিষ্কার। সব চেনা রাস্তা। চেনা গলি। কবীরের বাড়ি, মা আনন্দময়ীর আশ্রম, সীতারামদাসজীর আশ্রম, বাঙালিটোলা, ঘাটের পর ঘাট। ঘুরছি। সঙ্গে ঘাড়ের উপর ঘুরছে বেতালের মত ওমিক্রন আর ডেল্টার ভয়।
সেই আরতি, দূরে দাঁড়ালাম। কোনো পরিবর্তন নেই। সেই আবেগ। সেই উচ্ছ্বাস। আগে ছিল বোমার ভয়, এখন হল ভাইরাসের।
এত ভিড়, চলো পালাই। কাজ তো শেষ হল। এলাম বুদ্ধগয়ায়। গয়া স্টেশানে নামতেই করোনা র্যাপিড পরীক্ষা। নেগেটিভ।
বুদ্ধগয়া শুনশান। হোটেলের পর হোটেল বন্ধ। না টুরিস্ট, না তীর্থযাত্রী তেমন। খালি সন্ন্যাসীর মেলা। আগের বার যখন গিয়েছিলাম, সেই বোমা ফাটার আগে, তখন এত তল্লাশি ছিল না। এখন দু'বার তল্লাশি। বুদ্ধ হিংসার ঘেরাটোপে। দু'দিন আগে দেখলাম যীশুর মূর্তি কারা যেন ভেঙে দিয়ে গেল চার্চে ঢুকে। কারোর ভেঙে সুখ, কারোর গড়ে। আজকাল আর অবাক হই না। বুদ্ধমন্দিরের পাশে অতবড় জগন্নাথ মন্দির আগে ছিল? ছিল, ছোটো। এখন বড়। অনেক বড়। কে কখন বড় হবে এ ইতিহাসের জটিল হিসাব। মহাশূন্য কোল পেতে সব নেয়। অবাক হতে নেই।
অসিঘাট। বেণারস। এখানে ভোরে সূর্য ওঠার আগে বাঁধানো মঞ্চে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আয়োজন থাকে বারোমাস। বিহার থেকে আসা তরুণ শিল্পী গাইছেন আহির ভৈরব। সূর্য অল্প অল্প হাই তুলতে তুলতে উঠছে। কুয়াশা আর বিদেশী পাখির ঝাঁক ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যাচ্ছে নিজের মত ছন্দে। মন মজল।
সকালে আসুন, যজ্ঞে আহূতি দেবেন।
গেরুয়াধারী একজন বললেন।
তাকে আর কি করে বোঝাই যজ্ঞে আহূতি আর ভস্মে ঘি - এই দিয়েই তো সংসার রাতদিন চলছে বাপদাদু আমার! তোমার ও প্রতীকী ঘি দিয়ে কি হবে? কেউ ভ্রমে ভস্মে ঘি ঢেলে দিন কাটাচ্ছে, কেউ নাক-চোখ মুছতে মুছতে নিজের যা কিছু অল্প অল্প করে আহূতি দিয়ে যাচ্ছে। তবে তো সংসারটা গড়াচ্ছে রে বাপ আমার। নইলে কবে চাকা জ্যাম হয়ে লটকে পড়ে থাকত সব। মানুষ শুধু সাবধানী হলে কথা ছিল না, মানুষ বেপরোয়া বলেই তাকে নিয়ে ভয়, আবার ভরসাও।
রাতের অসিঘাট। সারাদেশের লোকনৃত্য আয়োজন করা হয়েছে মঞ্চে। ও বাব্বা, হঠাৎ কানের কাছে শুনি যেন একশোজন বাংলা সিনেমার নৃপতি 'সীতারাম সীতারাম' গাইতে শুরু করেছে। কি হল কেসটা? দেখি কি মাথার উপর চোঙা! সে চোঙার তার গিয়েছে সামনের মন্দিরে। ব্যাটা মোক্ষ ছেড়ে ওসব লোকনৃত্য দেখবি? কালচার? হুঃ! রাখ তোর কালচার। আগে মোক্ষ দিয়ে নিই তবে ওসব।
যা হোক, আবার বুদ্ধগয়ার গল্পে ফিরি। একি কেত্তন রে বাবা! কেউ হাজার হাজার কাপে জল ভরে সকালে সাজায়, বিকেলে ফেলে। কেউ কেউ কম্বলের আসন বানিয়ে নানা কায়দায় ডন দিয়েই যায়, দিয়েই যায়... আর মন্ত্রোচ্চারণ তো আছেই। দূর থেকে শুনে মনে হবে যেন ভীমরুলের চাক আছে ধারেকাছে কোথাও।
এই যে দাদা, এদিকে, আসুন…
কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। সন্ন্যাসী।
কি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? এই বলেই তিনি সেই বোধিবৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে বিগ্রেডের কায়দায় বুদ্ধের জীবনী শোনাচ্ছেন। আমি মনে মনে ভাবছি পার এপিসোড কত চাইতে পারেন? কারণ বিশ্বনাথের মন্দিরে যা অভিজ্ঞতা হল! পাণ্ডা প্রসাদের প্যাকেট বাজেয়াপ্ত করে বলে, টাকা না দিলে ছাড়বই না…
আমি বলি, আরে দাদা আপনার পিছনেই যে উনি, কি মনে করবেন? উনি যে আশুতোষ।
আর আশুতোষ। মোড়ে জায়েন্ট স্ক্রিনে তাঁর পুজোর লাইভ চলছে। ভদ্রলোকের প্রাইভেসি বলে কিছু রাখলো না।
আরে কি করেন... আরে এ কি করেন....
পুরুত প্রায় আমার ওয়ালেটের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে একখানা কড়কড়ে দু'শোটাকা তুলে নিল। বলল, হাম বাবাজী লোগোঁ কে লিয়ে….
আমি আর কি করি, আমার নিজের বাবার মুখটা মনে করে শান্ত হলাম। সে বৃদ্ধ মানুষটা বিশ্বনাথজীর প্রসাদের দিকে তাকিয়ে বসে যে! নে নে কেড়ে নে সব। তোদেরই তো দিন।
এদিকে তো গপ্পো বুদ্ধের সাধন অবধি হয়ে গেছে। বলে কি বুদ্ধ নাকি ধ্যান ভাঙার পরেই বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি... ধম্মং শরণম গচ্ছামি... সংঘং শরণম গচ্ছামি বলে একলাফে সারনাথে গিয়ে পৌঁছিয়েছিলেন।
মা গো মা, আমরাও পড়া মুখস্থ না হলে গ্যাঁজা মারতাম। তাই বলে এত! হায় হায়। মানুষটা অমন অহিংসার বাণী বলেছিলেন বলে তোরা যা কিছু বলে যাবি? এতটা অপারচুনিস্ট হওয়া কি ভালো? সংঘই নেই, তায় তার শরণ! এ যে 'ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথা পেলি' কেস।
এক বন্ধুর মোবাইল চুরি হল। বেণারসে। থানায় গেলুম। পুলিশের সেকি হয়রানি বাবা! এক মোবাইলের রিপোর্ট লেখাতে যদি এত সইতে হয়! তার খাবার জায়গায় লাইন পড়েছে কিনা সেটাও দেখে দিতে হবে আমাদের। আমরা বাধ্য। চুরি না, 'লস্ট' লিখুন। তার কায়দা আর শেষ হয় না। আমরা কেন হিন্দী লিখতে পারি না সেই নিয়ে তার বিস্ময়ের অবধি নেই। অনেক আলতু ফালতু বকে অবশেষে কাগজ দিল, তা দেখিয়ে সিম তোলা হল। আজই পড়লাম উত্তরপ্রদেশের মেয়েদের উপর অত্যাচার নাকি সর্বাধিক। তা এক মোবাইল চুরির রিপোর্ট লেখাতে যদি টুরিস্টদের এইমাত্রায় হেনস্থা হতে হয় তবে শ্লীলতাহানির রিপোর্ট লেখাতে গেলে যে কি হবে সে বিশ্বনাথই জানেন!
এইবার ফিরতে হবে। গয়া স্টেশানে আজকের ইংরেজি কাগজ চাইলে গতকালের দেয়। দিনের দিন আসে না। কি অদ্ভুত কাণ্ড! কিন্তু সে সব ভাবার সময় নেই, কারণ ততক্ষণে গয়াসুর রূপে আলুর পরোটা পেটে ঢুকে দক্ষযজ্ঞ লাগিয়েছে। তার কি বিত্তাপ বাড়ি এসে বেশ কয়েকদিন নিরালায় বসে বসে অনুভব করলাম। পেট যত বিদ্রোহ করে, চিত্ত তত বেণারসের ঘাট, বুদ্ধগয়ার জনশূন্য রাস্তা কল্পনা করে করে বলে, আমায় সেখানেই কেন রেখে এলে না বাপু। কি সুন্দর সাধুরা পোজ দিয়ে টাকা চাইছে! কি সুন্দর রীতিমতো বার্গেনিং হচ্ছে। এই তো আধুনিকীকরণ। এই তো সব কিছুর কেমন সুন্দর অবজেক্টিকরণ। সব কিছুই অবজেক্ট নয় সাবজেক্ট। আমি কি? আমি কি অবজেক্ট না সাবজেক্ট?
কবীর বলতেন, সত্যিটা কেউ শুনতে চায় না, মিথ্যা বললেই সব ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে। হার্ড ট্রুথ বনাম সফট লাই। কবীর যেন ভারতের বিবেক। অন্ধ বিশ্বাস কাকে বলে? যা সাধারণ বিশ্বাসের প্রতিকূল। কবীর সাধারণ বিশ্বাসে জাগাতে চাইলেন, আমরা অলৌকিক বিশ্বাসের কম্বল টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম। মন্দির সংস্কার হল। কিন্তু চিত্ত সংস্কারের রাস্তা নিয়ে কেউ কথা বলল না। আলোকে সর্বত্রগামী হতে দিতে নেই। মানুষ চায় না সেটা। নেটফ্লিক্স-এ একটা সিনেমা এসেছে, ডোন্ট লুক আপ। বেশ সিনেমা। তাকিয়ো না। তুমি যা ভাবতে চাও সেই সত্য, যা বাস্তবে আছে, হচ্ছে - সে নিয়ে মাথা ঘামাও কেন? জয়গুরু। কি তত্ত্ব মাইরি!