বাবা সেলুন খুলে রাখে রাত দশটা অবধি। আজ বলেছে ন'টায় বন্ধ করে দেবে।
অর্জন সামন্ত, ক্লাস থ্রি-তে পড়ে, সন্ধ্যে সাতটা থেকে এসে বাবার সেলুনে বসে। অর্জন সামন্তের গায়ে লাল একটা হাফ হাতা জামা, যার পকেটের গায়ে ছোটা ভীম আঁকা। আর নীচে একটা নস্যি রঙের হাফপ্যাণ্ট। দুটো জামা প্যান্ট হয়েছে অর্জন সামন্তের। এইটা ষষ্ঠী-সপ্তমীতে পরবে। আর নীল পাঞ্জাবি আর ধুতিটা অষ্টমী নবমী। ধুতিটায় গার্ডার দেওয়া আছে। মা দোকানে পরিয়ে দেখিয়েছে।
বাবার দোকানে আজ লোক তেমন নেই। কিন্তু বাবা বলেছে আসবে নাকি কেউ কেউ। অনেকেই পুজোর দিন চুল কাটাতে আসে। বাবা বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। বাবা নতুন জামা পরবে না। হয়নি। একটা লুঙ্গি হয়েছে। মা কিছু কেনেনি। বলেছে গতবারের পুজোর শাড়িটাই নতুন পড়ে আছে।
অর্জন সামন্ত বলল, বাবা, বেরোবে?
বাবা ঘড়ি দেখল, বলল, সবে পৌনে আটটা। নাহ, এখন না বাবু।
অর্জন সামন্তের রোল নাম্বার ছয়। সেকশান 'খ'। কোন কোন বন্ধু এতক্ষণে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে? অর্জন সামন্ত কড় গুনে দেখল সবাই বেরোবে। সে-ও বেরোবে।
একজন এলো। বাবা দাড়ি কেটে দিল। লোকটা বাবার সঙ্গে একটাও কথা বলল না। কতটাকা হয়েছে জিজ্ঞাসা করল, দিয়ে চলে গেল। অর্জন সামন্তের বাবা বলল, দেখলি, চলে গেলে এই টাকাটা পেতাম না।
অর্জন সামন্ত কিছু বলল না। প্রায় ন'টা বাজে। বাবা তবু উঠছে না। একজন ফোন করে বলেছে দু'জন বাচ্চা নিয়ে আসছে। একটু দেরি হবে।
ওরা এলো সাড়ে ন'টায়। টোটোতে করে। বাচ্চাদুটো ন্যাড়া হবে। বাবা হেসে হেসে ওদের সঙ্গে কথা বলছে। রাগ হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে অর্জন সামন্তের।
একটু পর মা এসে দাঁড়ালো সেলুনের সামনে। মাকে একটুও ভালো লাগছে না। বাড়িতে পরা শাড়িটাই পরে এসেছে। বলল, এসো বাবু, বাবার আজকে হবে না, আমরা ঘুরে আসি।
অর্জন সামন্তর কান্না পেল। বাবার দিকে আয়নার মধ্যে দিয়ে তাকালো। মাথাটা নীচু করে সেলুন থেকে বেরিয়ে এলো। বাবা মায়ের হাতে টাকা দিল। এগরোল কিনে দিও। বাবা বলল।
অনেক রাতে বাবা বাড়ি এলো। দরজার আওয়াজে বুঝল। অর্জন সামন্ত খেয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘুমায়নি। বাবাকে মা ফিসফিস করে বলছে, কিচ্ছু খায়নি জানো.... এক প্যাকেট বাদামও ছেলে খাবে না.....
বাবা ঘরে ঢুকল। অর্জন সামন্ত চোখ বন্ধ করে শুয়ে। বাবা বলছে মাকে, ঘুমিয়ে গেছে.... ঠিক আছে... কাল ওর জন্য একটা এগরোল কিনে নিয়ে আসব আমি..... রাতে বাইরেই খেয়ে নেব কাল....
মা বলছে, না না, থাক.... ওকে একটা রোল কিনে দিও.... তুমি না কিনে দিলে খাবে না.... আমি যা হোক রান্না করেই বেরোব...... বাইরের ওসব খেলে আমার শরীর খারাপ হয় জানো তো......
অর্জন সামন্তের চোখের থেকে বড় বড় দু'ফোঁটা জল কখন মাথার বালিশের সবুজ ওয়াড়টা ভিজিয়েছে সে নিজেও জানে না। তবে তার ঘুম এসে গেল, এগরোলের গন্ধে আর বাবার জামার সিগারেট সিগারেট গন্ধে।