- টোটোওয়ালা দাঁড়াও, আমি হিসি করব।
- আমিও করব। আরেকটু চলুন, সামনেই একটা ফাঁকা মোড়, পাশে ঝোপ।
- সেই ঝোপে সাপ আছে?
- কেন?
- আজ অবধি কেউ ঝোপে হিসি করতে গিয়ে সাপে কেটে মরেছে?
- আপনার সাপের ভয়?
- না, মরার। তার চেয়ে বেশি পোড়ার। ধরো ভবিষ্যতে জানা গেল মৃত মানুষেরাও বুঝতে পারে সে পুড়ছে। তখন?
- ভেবে দেখিনি….
- ভাবো... বেঁচে থাকতেই ভেবে নিতে হয়…
- নামুন
- কেন?
- হিসি করবেন না?
- ও, এসো... তুমিও তো করবে… একটু কাছে দাঁড়িও…আমার অন্ধকারে ভয় করে…
- আচ্ছা নিন... শুরু করুন….
- আহা... কতক্ষণ চাপা… তারপর তোমার টোটোর যা ঝাঁকুনি…
- রাস্তার জন্য ওটা…
- তাও ঠিক….. আচ্ছা ধরো এখন তোমায় একটা সাপে কামড়ালো…
- কেন কামড়াতে যাবে…?
- না ধরো... তোমার শেষ ইচ্ছা কি হবে?
- কেন শেষ ইচ্ছা হবে... আমি হাস্পাতালে যাব….
- ধরো আমি আটকে দিলাম… যেতে দিলাম না…
- আপনি পাগল…. যাবেন তো... উঠুন….
- যাব না…. এই দেখো…
- একি! কি পুকুরে ছুঁড়ে ফেললেন?
- তোমার টোটোর চাবি…
- মানে... কেন?
- তোমার তো ফোন নেই... তুমি পুলিশেও ফোন করতে পারবে না… এবার বলো... যদি এখন একটা সাপে কামড়ায়... কি শেষ ইচ্ছা তোমার?
- জানি না... ভাবিনি…
- ভাবো... এসো টোটোয় বসে বসে ভাবি... এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে মাথায় হিম পড়বে…
- আজব লোক তো আপনি...! এদিকে সাপের কামড়ে মারছেন.. অন্যদিকে আমার ঠাণ্ডা লাগার কথা বলছেন…
- এসো…..
[মিনিট দশেক পর…]
- কিছু ভাবলে?
- না, আমার ভয় করছে
- আমাদের সারাজীবন শুধু ভয়ই করে.. আচ্ছা তোমার ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি... এখন তোমার বয়েস কত?
- ছেচল্লিশ
- আচ্ছা ধরো, এই ছেচল্লিশ বছর বয়েস অবধি তোমার যত ভয় যদি ইট ভাবো.. তবে ক'তলা বাড়ি হবে..? হাসছ যে? হেসো না.. বলো.. ক'তলা বিল্ডিং হবে?
- হবে একশো-দুশো তলা…
- দেখো, তোমার মুখে হাসি... তোমার এখন ভয় করছে না... কেন বলো তো?
- কেন?
- কারণ তুমি ভয়কে স্পষ্ট দেখছ এখন... ইটের মত করে দেখছো... তাই ভয় নেই... একটা কাজ করবে?
- কি?
- আমার ব্যাগে একটা সিরিঞ্জ আর ওষুধ আছে... আমার গায়ে একটু ফুটিয়ে দেবে?
- আপনার সুগার আছে? ইনসুলিন?
- হ্যাঁ ইনসুলিন…
- কিন্তু ওটা কিছু খাবার সঙ্গে না থাকলে খেলে তো বিপদ…
- তুমি বড্ড ভাবো.. আসলে তুমি ভালো মানুষ... আমি জানি... আমি তোমায় ফলো করেছি... তোমার টাকার দরকার... মেয়েটাকে নিয়ে বড় হাস্পাতালে যাবে... নার্ভের অসুখ... জানি.. অবাক হচ্ছ তো?
- তা হচ্ছি… কিন্তু আপনি?
- দেখো তোমায় আমি মিথ্যা বলেছিলাম... এতে ইনসুলিন নেই, বিষ আছে... আমায় দিয়ে দাও.. আমি এক লাখ টাকার চেক এনেছি... তোমায় লিখে দিচ্ছি…
- কেন?
- কারণ আমি বাঁচতে চাই না….
[একটা বাইক এসে দাঁড়ালো…. পুলিশ...]
- আপনারা এত রাতে কি করছেন এখানে?
টোটোওয়ালা থতমত খেয়ে বলল, না মানে একটু কথা বলছিলাম…
- এখানে? এত রাতে?
- আপনিই বা এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? ডিউটি তো শেষ... বাড়িতে বউও তো নেই... আসুন বসি... গল্প করি…
- মানে? আপনি আমায় চেনেন?
- বাহ্ রে, আমার ছেলের পাসপোর্ট ভেরিফিকেশানের সময় মিষ্টির টাকা কে নিল…
[পুলিশ এসে সামনে বসল]
- তবে আমরা তিনজন। মোদ্দা কথা হল, আমি মরতে চলেছি, ইনি আমায় একটা ইঞ্জেকশন দেবেন, আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ... তারপর যে যার বাড়ি চলে যাবেন.. সঙ্গে এই প্রতুলবাবু, আমার কাছ থেকে, মানে রিটায়ার্ড রেলওয়ে এমপ্লয়ি সুনির্মল চ্যাটুজ্জের থেকে একলাখ টাকা নিয়ে মেয়ের চিকিৎসার জন্য বড় হাস্পাতালে যাবেন। আর আপনি বিনয় সামন্ত সাক্ষী থাকবেন।
বিনয় - মশকরা করছেন?
সুনির্মল - নিজের মৃত্যু নিয়ে নিজেই মশকরা করব? সারাটা জীবনে মশকরা কম হল?
বিনয় - ফ্রাস্ট্রেটেড কেন হচ্ছেন? আমরা সবাই মোর অর লেস ফ্রাস্ট্রেটেড.. সবাই.. আপনি নন চালকবাবু?
প্রতুল - আমিও…
বিনয় - তা বলে মরবেন?
সুনির্মল - হ্যাঁ… চাইলে আপনারাও আমার সাথে মরতে পারেন... বেশ একটা গণচাঞ্চল্য হবে.. আজকের জীবন তো ব্রেকিং নিউজ ছাড়া চলে না মশায়... পর্যাপ্ত বিষ আছে.. এক্সট্রা সিরিঞ্জও আছে.. .নেবেন?
প্রতুল - আমার কেন জানি ইচ্ছা করছে…
বিনয় - মানে? মরতে?
প্রতুল - আমি মৃত্যুকে এত গভীরভাবে ভাবিনি... কি হবে শালা বেঁচে বলতে পারেন? সব একঘেয়ে... এমনকি মেয়েমানুষের শরীর দেখলেও মনে হয় চেনা টুরিস্ট স্পট…
সুনির্মল - পুরীর মত... হো হো হো…
বিনয় - আপনি কি হিপনোটিজম জানেন?
সুনির্মল - কেন? ইনি আমার সঙ্গে সহমরণে যাবেন বলে? হো হো…
এই এই শোনো... তুমি চম্পা তো... এসো এসো…. এদিকে এসো….
চম্পা - তিনজন আমি নিই না….
বিনয় - যাহ বাঁড়া... এ আবার কোত্থেকে জুটল…
সুনির্মল - এসো বোসো... আমার পাশেই বসো.. এই.. কি ভালো হল... চারজন… সংক্ষেপে বিষয়টা হল এই...
চম্পা - কি ক্যাঁচাল... আমি এর মধ্যে কেন? তাছাড়া আমায় নিয়ে মরলে সমাজে আপনাদের নামে স্ক্যাণ্ডাল হবে... সারা জীবনের সব নাম ফুস্…
বিনয় - তবে? তাছাড়া কে মরছে... এই বুড়ো একটা ফ্রাস্টু খাওয়া মাল... রাতে বাওয়াল করছে... ইন্টারেস্টিং লাগছে তাই বসলাম... ভালো এন্টারটেইনিং হচ্ছে... কি দাদা..
প্রতুল - জানি না... আমার কিন্তু মন বলছে দাদা ঠিক... এই যে আমরা সবাই বেঁচে আছি... কি লাভ? আর আপনি যে স্ক্যাণ্ডালের কথা বলছেন… কি হবে? লোকে ক'দিন মনে রাখে? কেউ মনে রাখে না... দাদা আপনি সিরিঞ্জে ওষুধ ভরুন তো…
বিনয় - মানে? আমি অফ ডিউটি হতে পারি, তা বলে আমার সামনে দু'জন আত্মহত্যা করবে আর আমি দেখব? সে যতই ঘুষখোর হই না কেন? আমি হতে দেব না... না দাদা, আপনি কিচ্ছু বের করবেন না ওসব…
সুনির্মল - আচ্ছা এখনই বের করছি না... আচ্ছা চম্পা তোমার সুইসাইড করতে ইচ্ছা করে না…
চম্পা - রোজই তো করি... স্লো পয়জন... রোজই তো মরছি….
প্রতুল - আমিও…
বিনয় - সে তো আমিও... রোজ রোজ শালা অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যাচ্ছি…
সুনির্মল - আমরা রোজ অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যাচ্ছি... আমার বয়েস একাত্তর, আমার আর ফুরাবার কিছু নেই... তবে একটা কথা স্পষ্ট জেনো... তোমাদের রোজ মনে হবে... সারাটা জীবন মনে হবে...অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যাচ্ছ... তারপর একদিন দেখবে সত্যিই ফুরিয়ে গেছ….
বিনয় - আমি এরকম ছিলাম না... আদর্শবাদী একজন মানুষ ছিলাম... তারপর নিজেকে কেমন জংলী লাগতে লাগল... মনে হল এত অড বেঁচে লাভ কি? পুরো সিস্টেমটাই তো…. ধুস্.. এই, আপনার কাছে মালের বোতল আছে…
চম্পা - আমার কাছে আছে... সস্তা... চলবে?
বিনয় - চলবে….
[মিনিট কুড়ি পর….]
সুনির্মল - তবে ঠিক হল কি? আমি আর প্রতুল?
বিনয় - না, আমিও ভাবছি দিই শেষ করে শালা... বার করুন.. আগে আপনাদের দিয়ে আমি নিজেই নিয়ে নিই…
চম্পা - দাঁড়ান... আপনারা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন... আমার চাইতে খারাপ কি আপনাদের অবস্থা? আমার তো তবু মনে হয় কেউ একজন আসবে, আমায় ভালোবাসবে… আমার ঘর হবে... নিজের সংসার হবে…
প্রতুল - বাল হবে…
সুনির্মল - সেই... ওসব ভাবতেই ভালো... আদতে কিস্যু নেই... যেদিনই অ্যাডজাস্টমেন্ট এর সূত্র ভুলবে… কম্প্রোমাইজের পাতা ঢাকনা খুলবে... সব শুধু গু আর গু... সংসার মানে ঢাকা কমোড….
বিনয় - কেউ ফ্লাশ করে না…
সুনির্মল - হো হো… সবাই ভাবে তার গু অন্য কেউ ফ্লাশ করবে….
চম্পা - আপনারা এখন করতে চান আমার সঙ্গে, ফ্রিতে দেব... করুন.. কিন্তু এসব বলা থামান... মরবেন না... যান বাড়ি যান প্লিজ….
সুনির্মল - আর কে কি করবে আমি জানি না…. কিন্তু আমি….
[হঠাৎ একটা অল্প বয়েসী ছেলে দৌড়ে এলো...যেন অন্ধকার থেকে উদয় হল...]
- দাদা একটা অ্যম্বুলেন্স হবে এদিকে কোথাও... মায়ের ভীষণ বুকে ব্যথা হচ্ছে... আমি এ পাড়ায় নতুন…. কাউকে চিনি না.. আপনাদের অনেকক্ষণ থেকে দেখছি... মানে ওই জানলা দিয়ে দেখছি গল্প করছেন... তাই.. প্লিজ... একটু দেখুন না প্লিজ….
সুনির্মল - এই নাও চাবি... এখন কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই... ওটা আমার বাড়ির চাবি ছিল….
বিনয় - চলুন আমি যাচ্ছি…. আপনার মা-কে আনুন…. আপনিও চলুন ম্যাডাম, একজন মেয়ে থাকলে সুবিধা হবে…
চম্পা - আচ্ছা, চলুন।
আগন্তুক ছেলে - প্লিজ সত্যিই আপনি গেলে আমার খুব সুবিধা হবে….
বিনয় - এই যে ফাস্টু জেঠু, আপনি আমার পিছনে বসুন... বাড়িতে তো ঢুকতে পারবেন না...চাবি তো নেই...
সুনির্মল - কিন্তু ওর ডেডবডিটা?
বিনয় - মানে?
সুনির্মল - মানে আমার স্ত্রী-র…
বিনয় - খুন করেছেন?
সুনির্মল - গত পরশু… পাঁচ বছর প্যারালাইসিস ছিল... আর সহ্য করতে পারছিলাম না জানেন.. আমার সময় আর ছ'মাস... ক্যান্সার তাই…. বালিশ চাপা দিয়ে….
দূরে টোটোটা মিলিয়ে যাচ্ছে... চম্পার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আগন্তুকের মা... আগন্তুক পাশে বসে….
সুনির্মল রাস্তার মাঝখানে বসে কাঁদছে…. একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করছে বিনয়.. রাতটা পাঁচিলের গারদের মত….একটা মিথ্যা...এই ধর্ম এখন...সত্যিই কি খুন? না না না…..
[ছবি: Suman]