কিছু নিন্দুক আমাকে ভৎর্সনা করিয়া বলিতেছেন ধর্মে আমার মতি নাই, তাই এ হেন ভৌটিক ফলাফলে কোনো আসন্ন স্বজাতি অবলুপ্তির আশঙ্কা করিতেছি না। অপরদিকে বামাচারী রাজনীতির বন্ধুরা চক্ষু রাঙাইয়া বলিতেছেন আমি আমার বৌদ্ধিক ক্ষমতার যথোপযুক্ত ব্যবহার করিতেছি না। অতএব এমত অবস্থায় আমায় আত্মপক্ষ সমর্থনে গুটিকয়েক কথা না বলিলেই নয়।
প্রথম কথা আমি তো আস্তিক বটেই। যেইদিন হইতে জানিয়াছি জগতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম হইতে শ্রেষ্ঠ আর কোনো সম্পদ নাই, সেইদিন হইতে ওনার শ্রীচরণযুগলের মাপ জগৎ সংসারে প্রশ্ন করিয়া ফিরিতেছি। শাস্ত্রের পর শাস্ত্র ঘাঁটিয়া চশমার কাঁচের ওজন ও প্রস্থ বাড়াইয়াছি, সৎসঙ্গ করিয়াছি, কিন্তু কেহ আমায় জানায় নাই। আমায় বলা হইয়াছে, ওঁর চরণে আমার হৃদয় ধরিয়া দিলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হইবে আপনিই। সেখানেও আমি প্রশ্ন করিয়াছি, উনি কোন প্রকোষ্ঠে ওঁর শ্রীচরণযুগল রাখিবেন? হৃদয়ে একটি বাম প্রকোষ্ঠ ও ডান প্রকোষ্ঠ আছে পড়িয়াছি। বামে কি উনি রাজি হইবেন? কিন্তু ডানে শুনিয়াছি দূষিত রক্ত প্রবাহিত হইয়া থাকে। তো এ হেন জটিল দ্বান্দ্বিক অবস্থায় কি করিয়া হৃদয় ওঁর চরণে দান করি?
কেহ কোনো উত্তর করিল না। আর দেখুন, যেহেতু আমি সমস্ত সংসারে সবাইকে ব্রহ্ম দ্বারা আচ্ছাদিত দেখি, অগত্যা আমি যে সাম্যবাদী ইহা লইয়া কোনো সংশয় রহিতেই পারে না। মায় শ্রীকৃষ্ণ অবধি গীতায় বলিয়াছেন সাম্যে মন স্থির রাখাই জীবনের উদ্দেশ্য। তবে? এখন কাহারো পার্শ্বে দাঁড়াইতে চাহিলে সে যদি তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে না দেয়, তবু জোর করিয়া দাঁড়াইতে চাহিলে তাহাকে ‘গায়ে পড়া’ মানুষ বলে না? সাম্যবাদী হইব বলিয়া কি গায়ে পড়া হইতে হইবেক? বিশেষ করিয়া এই সামাজিক দূরত্ব রাখিবার কালে?
অগত্যা আমি ভীষণভাবেই একজন আস্তিক সাম্যবাদী মানুষ এই লইয়া কোনো গোল থাকিল না। পূর্বে ভাবিতাম কিছু পুস্তক অধ্যয়ন করিয়াছি, তাহাতে কিছু হইলেও জ্ঞান হইয়াছে। কিন্তু এই ফেসবুকে আসিয়া নানা ব্যক্তির সহিত পরিচয় হইয়া বুঝিয়াছি উহাদের পাঠ তালিকার কাছে আমি ভাইরাস অপেক্ষাও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অগত্যা একে নানা সংশয়, তাহার উপরে পঠিত জ্ঞানের পরিমাণ এতই সামান্য যে সে সব ছাড়িয়া এখন নানা প্রকার ওটিটিতে মনোনিবেশ করিয়াছি। এই যেমন নেটফ্লিক্সের নানা ওয়েব সিরিজ দেখিয়া আমার জ্ঞান হইয়াছে, দুটি পুরুষের মুখোমুখি দেখা হইলেই গোলাগুলি হইবার সম্ভাবনা, আর একজন পুরুষ ও একজন নারী মুখোমুখি হইলেই বিবস্ত্র হইয়া আদিম যোগে যাইবার সম্ভাবনা। অর্থাৎ বুঝিতেছেন, আপনাদের কারোর মনের মত উত্তর সাজাইয়া লিখিবার অবকাশ ও ইচ্ছা দুটোই আমার নাই। প্রতিদিন যে শ্বাস গ্রহণ করিতে সক্ষম হইতেছি, এবং আশেপাশের আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-প্রতিবেশী যাহারা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস গ্রহণ করিতে পারিতেছেন তাহাদের সবার সৌভাগ্যকে স্বীকার করিতেছি নতমস্তকে। কিন্তু আজ ভীষণ দুর্দিনে এত হাহাকারে কাহারো গর্বের আত্মস্ফীতি দেখিয়া লজ্জায় মাথা নীচু হইতেছে। তিনি নেতা হোন, চিকিৎসক হোন, কোনোরূপ সাহায্যপ্রণেতা হোন, “মনে রেখো, আমিই ছিলাম” গোছের উক্তিকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইতেছি। একে অন্যকে তুচ্ছ করিবার প্রবৃত্তি দেখিয়া স্তম্ভিত হইতেছি। সদ্য শ্রী সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের শতবর্ষ গেল। তিনি তাঁহার একটি সিনেমায় 'Floccinaucinihilipilification' শব্দটি ব্যবহার করিয়াছিলেন। অন্যতম দীর্ঘ ইংরাজি শব্দ যাহার অর্থ কাহাকেও তুচ্ছ করা। এই প্রবৃত্তিটি তো স্বাস্থ্যকর নহে, এই দুঃসময়ে।