Skip to main content

পাখিরালয়ের ভেতরের দিকে এক গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা হচ্ছে। মাটির বাড়ি। সামনে কয়েকটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। মানুষটার বয়েস আন্দাজ ষাটের উপর। একটা চেক চেক লুঙ্গি পরা, ফুলহাতা সোয়েটারের উপর একটা চাদর জড়ানো গায়ে। মাথায় উলের টুপি। হাতে বোনা মনে হল। সবগুলোর অবস্থাই জীর্ণ।

    কথা হচ্ছে আম্ফান ঝড় নিয়ে। ওনার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই সাইক্লোন রিলিফ সেন্টার। উনি সেই সেন্টারেই কাটিয়েছেন ঝড়ের সময়টা। সে তাণ্ডব মুখে বর্ণনা করা যায় না, এমন বলে কিছুক্ষণ দূরে তাকিয়ে কি ভাবলেন। রাস্তার ওপারে সূর্য উঠেছে। শীতের কুয়াশা জড়ানো অলস সূর্য। সূর্য ভীষণ মিথ্যাবাদী। প্রতিটা সকালে সে যেন আমার জন্যেই ওঠে। কিন্তু দিনের শেষে সব অন্যরকম।

    মানুষটা উদাস চোখে তাকিয়ে রাস্তার দিকে এখনও। কথা খুঁজছেন না, কথায় হারিয়ে গেছেন। অতীতের কথা। মন আবার পাগলের মত আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বসতে চাইছে। মানুষটা জানে জীবনের আয় আর ব্যয়ের হিসাব মেলানো যায় না। মন একটু পর পাগলের মত করবে। সব নিজের ভিতরেই তছনছ করে ফেলতে চাইবে, তখন?

    আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আগে এদিকে বাঘ চলে আসত। এখন আসে না। জঙ্গলে তারের বেড়া দেওয়া আছে না? দেখেছেন?

    কথা বলে চলেছেন। মাটির বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে বললেন, এই বাড়ি নতুন। আমার বাড়ি মাটি ভেঙে নদীতে ঢুকে গেছে। এই কয়েক বছর হল এদিকে এসেছি। কিছুই করতে পারলাম না, বাড়িটাও ঠিক হল না। আর কি করব?

    আমি বড় রাস্তার দিকে তাকালাম। কয়েকটা কুকুর জটলা পাকিয়ে শুয়ে। বড় রাস্তাটা গোসাবা গেছে। এখান থেকে নাকি ৭ কিলোমিটার, ফলকে লেখা। বিদ্যাসাগর ফলক পড়ে সংখ্যা চিনেছিলেন। মাতৃভাষা নিয়ে বড় ভাবনা ছিল মানুষটার।

    বললাম, এগোই তবে?

    চোখের দৃষ্টি কতটা নদীর ভাঙনে ভেসে যাচ্ছে সে নিজেও বোধ করি জানে না। মানুষ নিজের সম্বন্ধে আসলে কিচ্ছু জানে না। তার শরীরকে তাও চিকিৎসক বোঝে। কিন্তু মন? মনোবিদ? সেও বা কতটা? মনের মধ্যে ভাষার মৌচাক। ভনভন করে যাচ্ছে। ভাষায় তুমি কি জমিয়েছ? মধু না বিষ?

    আমরা এগোচ্ছি। উনি পিছনে পিছনে আসছেন। চাষী মানুষ। আবার পরিবারের কেউ মাছ ধরে। বড়ছেলের কথা বললেন, সম্ভবত। মাটি আর জল দুই রোজগারের উপায়। কিন্তু তাও মেটে না... যা হয় তাতে অপর্যাপ্ত বস্ত্রের মত সে প্রয়োজনের উলঙ্গপনাকে আরো নগ্ন করে রাখে।


    পাখিরালা প্রাথমিক বিদ্যালয়। খুব অপরিষ্কার চারদিক। হবে নাই বা কেন, এতদিন বন্ধ যে। দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা, কাগজপত্র সঠিক দেখাতে না পারলেও তাকে যেন স্কুল ফিরিয়ে না দেয়।

    এই স্কুলে বাংলায় পড়ানো হয়। মাস্টার বাংলায় কথা বলেন, ছাত্রছাত্রীরাও বাংলায় কথা বলে। মজা হয়, দুষ্টুমি হয়, শাসন হয়, সব বাংলায়। অথচ আমার রাজ্যেই কত স্কুলে বাংলায় কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সে নাকি ওতে ইংরাজিতে দড় হবে না। আসলে কাকে কিরকম হতে হবে আমরা সবাই জানি। বড্ড বেশি জানি। তাই জানি না কোন চর কখন ভেঙে সময়ের নদীতে ভেসে যাবে। সব স্বপ্ন ভেসে যাবে।

    এই মানুষটাকে যদি জিজ্ঞাসা করি আপনি মাতৃভাষা দিবস নিয়ে কিছু বলবেন?

    সে ওনাকে অপমান করা হবে। তিনি আর তাঁর ভাষা কি আলাদা! যার নিজের প্রাণের বাইরে অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, তাকে নিয়ে উৎসব কিসের?

    তবু উৎসব করা যায় যদি এই ভাষার শ্রেনীবৈষম্য পার্থক্যটা না থাকে তো। কিন্তু সে তো থাকবেই, তাই উৎসবটুকুও থাকবে শহরে, যেখানে অনেক ভালো মডেলের দুটো ভাষা চলে এসেছে, ইংরাজি আর হিন্দি। সে আমরা যতই মাতৃভাষা নিয়ে দরদ দেখাই না কেন, অবশেষে সে ইংরাজি বা হিন্দির কাছে আত্মসমর্পণ করবে সে আমরা জানি, আর করবেই বা বলছি কেন, করে তো ফেলেইছে।

    কিন্তু এই গ্রাম বাংলায় এখনও এই ভাষাটা তার সমস্ত হীনমন্যতা, অপমান ছেড়ে মেঠো রাস্তায় সগর্বে হেঁটে ফিরে চলেছে। এইটুকুতেই ধন্য ধন্য হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যাসাগর যেন এই সুন্দরবনের পাখিরালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এসে যে কোনো মুহূর্তে দাঁড়াবেন। আমায় দেখেই বলবেন, এখানে কি করছেন? কেন পরিবেশটা বিষাক্ত করে তুলবেন? যান যান, এদের মধ্যে বিষ ছড়াবেন না। ওদের হীনমন্যতাবোধ জাগিয়ে ওদের উপকারের জন্য ঝাঁপাবেন না, এ ভীষণ পুরোনো খেলা। আসুন এখন, আমরা ক্লাস শুরু করব।

    আমি যেন স্পষ্ট দেখছি গায়ের চাদরটাকে এক ঝটকায়ে গায়ে আবার জড়িয়ে বৃহৎ মস্তিষ্ক আর হৃদয় মানুষটা সব ছাত্রছাত্রীদের ডেকে বলছেন, আয় শুরু করা যাক।

    সেই বয়স্ক মানুষটা ফিরে গেছেন। আমার চারদিকে অন্য বাংলার মানুষরা। যাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুখে রবীন্দ্রনাথ ততটা সত্যি নয় যতটা বনবিবি। তাদের গীতবিতান নেই, ভাষা নিয়ে লেকচার নেই। শুধু ভাষাটা আছে। তাদের বসত বাড়ির চারদিকে যেমন নদী, তেমন সারাটা জীবনজুড়ে এই ভাষা, এ দ্বীপ সে দ্বীপ করে বেড়াচ্ছে। শহুরে বাবুরা মধ্যরাত অবধি হোটেলের বাইরে মদ খেয়ে উদ্দাম বক্স বাজিয়ে নাচে চীৎকারে আধুনিক জীবনযাত্রার জয়গান করবে। সারা গ্রাম কেঁপে কেঁপে উঠবে সে বিটের আঘাতে আঘাতে। কেউ কিচ্ছু বলবে না। কারণ বলতে নেই, এটাই রীতি।

    শুধু বিদ্যাসাগর কয়েকটা মানুষকে নিয়ে আজও গ্রামেগঞ্জের রাস্তাঘাটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ আ ই ঈ শিখিয়ে যাবেন, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Category