শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, লেখাপড়া করে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
তবে কি হিমালয়ের গুহায় যেতে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ কোনোদিন হিমালয় দেখেননি। শান্তি পেতে কোনো গুহায় গিয়ে সেঁধিয়ে বসেননি। এমনকি তীর্থে গিয়েও শান্তি পাননি।
ঈশ্বর কি আছেন? সত্যিই কি ভগবান বলে কিছু হয়? জীবন রহস্যের পর রহস্যে আবৃত। এ অনুভব করা যায়। কিন্তু সত্যিই কি এ রহস্যের গভীরে কোনো সত্য আছে? কোনো সংহতি আছে?
চুপ করে বসে থাকা একটা পশু আর মানুষের মধ্যে তো কী ভীষণ পার্থক্য। মানুষ বাইরে চুপ করে ভিতরে সাম্রাজ্য বানিয়ে ফেলছে। বাড়ি-ঘর-দোর সব বানিয়ে ফেলছে। বাইরের মানুষকে ভিতরে এনে শত্রু, বন্ধু, উদাসীন, সুহৃদ, প্রতিবেশী, আত্মীয়, পরিবার ইত্যাদি ইত্যাদি কত পরিচয় তৈরি করে নিচ্ছে। সম্পর্ক বাইরের জিনিস তো না, ভিতরের জিনিস। সে সম্পর্কের আয়নায় নিজের অস্তিত্বকে পরখ করছে। নিজের মূল্য নির্ধারণ করছে। নিজেকে কখনও সুখী, সার্থক, সফল অনুভব করছে। আবার কখনও ব্যর্থ, দুঃখী, বঞ্চিত অনুভব করছে। সব কিছুকে সুখের দিকে নিয়ে যেতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করছে। আবার সব কিছু দুঃখের দিকে গড়িয়ে গেলেই কপাল চাপড়াচ্ছে।
এ তো গেল তার ভিতরের পরিস্থিতি। বাইরের পরিস্থিতি আরো সঙ্গীন। সেখানে সে কোথাও অনুগত, কোথাও বিদ্রোহী, কোথাও নম্র, কোথাও বিরক্ত, কোথাও স্বাচ্ছন্দ্য, কোথাও সংকটে, কোথাও ফাটা বাঁশে, কোথাও বাঁশের ডগায়, কোথাও আনন্দের ঢেউয়ে, কোথাও ক্রুদ্ধ আগ্নেয়গিরি, কোথাও মরণের কাছাকাছি, কোথাও জীবনের হাত ধরে।
এত কিছুর মধ্যে তার উপর একটাই আদেশ, ভারসাম্য রেখে চলো। ব্যালেন্স করো।
কে করবে? যে করবে, সে কে? তাকে জন্ম থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে চলনসই একজন বানানো তো হয়েছে। কিন্তু কী সে শিখেছে? সে সিলেবাসের অঙ্ক-ইতিহাস-ভুগোল-সাহিত্য ইত্যাদি শিখেছে, সে চালাকি-দুষ্টুমি-ধ্যাষ্টামো শিখেছে, কদাচিৎ মাঝে মাঝে সততা, করুণাও দেখেছে, ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে, নানা আচারের কাছে নত হয়েছে, মেনে নিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, সামাজিক প্রথার নামে যা কিছুর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছে। যত জেনেছে তত কনফিউজড হয়েছে। যত কনফিউজড হয়েছে তত কম ভাবার চেষ্টা করেছে। যত কম ভাবার চেষ্টা করেছে তত যান্ত্রিক হয়েছে। যত যান্ত্রিক হয়েছে তত মিথ্যা হয়েছে। মিথ্যা হতে হতে বিষণ্ণ হয়েছে। অসংবেদনশীল হয়েছে। একদিন পাগল হয়েছে, না তো পাথর হয়েছে।
এই মানুষ ব্যালেন্স করবে? কতদিন করবে? কতটা করবে? কতদিক করবে? কোনটা তার সংহতিপূর্ণ? কোনটা তার ভূমিস্থ, মানে গ্রাউণ্ডেড? সব তো জট পাকিয়ে তাকে নিয়ে ঝুলে আছে। সে দাঁড়াবে কোথায়? তার যেতেও দ্বন্দ্ব, দাঁড়াতেও দ্বন্দ্ব। সুখেও দ্বন্দ্ব, দুঃখেও দ্বন্দ্ব। তার প্রেমেও দ্বন্দ্ব, অপ্রেমেও দ্বন্দ্ব। তার জাগরণ মানেই দ্বন্দ্ব। জীবন মানেই দ্বন্দ্ব।
এ ব্যালেন্স করবে? কী করে করবে? তার কী যাদুকাঠি আছে? কিচ্ছু নেই। আজীবন সে যাদুকরের অপেক্ষায় থাকে। আজীবন সে আশঙ্কায়, আতঙ্কে থাকতে থাকতে কাল্পনিক আনন্দময় বিভুর দিকে তাকিয়ে বাঁচে। কিন্তু কই সে? শেষে একটা একটা করে সুতো ছেড়ে দেয়। জীবনকে বলে যেদিকে নিয়ে যাও, যাও। আমার আর কিছু বলার নেই। চাওয়ার নেই। শুধু আমাকে পাগল করে দিও না।
যদি সৌভাগ্য হয়, তবে কোনো একদিন সে তার অবশিষ্ট বোধের টিমটিমে শিখাটুকুকে প্রশ্ন করে, কে তুমি? আকাশের মত উদাসীন, আমার সব কিছুর সাক্ষী, নিরুত্তর, কে তুমি?
এইখান থেকে শুরু হয় তার মধ্যে একটা নতুন যাত্রা। সে যাত্রার ট্যুর কন্ডাকটর যে কেউ হতে পারে। এ লেখায় শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ দেন না। গল্প বলেন। গল্পের মধ্যে ভিসা-পাসপোর্টের কোড আছে। এনক্রিপ্টেড। লুকানো। গোটা জগতই এনক্রিপ্টেড। পারবে বুঝতে? এসো, আমার কাছে এসো। আমি গুরু নই, কর্তা নই, ঈশ্বরটিশ্বর কিচ্ছু নই, আমি আদতে কিচ্ছু নই। তোমার মধ্যে একটা ঘাপটি মেরে থাকা গুটিসুটি চেতনা আছে। ওই চেতনার কাছাকাছি যত আসবে, তত জুড়াবে। বাইরে কিচ্ছুটি পরিবর্তন করতে হবে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তুমি বদলে যাবে। আসবে?
গঙ্গা বয়ে চলেছে। শান্ত শীতল হাওয়া বইছে। হিমালয়ের গুহা না, কোনো গভীর অরণ্যের মধ্যে কুটির বানানো কেউ না, প্রাচীন বইয়ের কোনো ধোঁয়া ধোঁয়া বিশ্বাসে অবিশ্বাসে মেশানো চরিত্র না। একজন সরল সহজ ভাষায় কথা বলা মানুষ বসে আছে। শুধু একটু কাছে এসে বসলেই হয়। কথাগুলো প্রাণের মধ্যে নিয়ে, নির্জনে, নিভৃতে একটু নাড়াচাড়া করলেই হয়। প্রাণে এক সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করে। তার কোনো দাবী নেই। তার কোনো কর্তৃত্ববোধ নেই। তার কিছুই চাওয়ার নেই। তোমাকে শুধু গল্প শোনানোর আছে। যে গল্প জীবনের জটিল এনক্রিপ্টেড কোডগুলো ভাঙবে। তোমাকে কিচ্ছু বিশ্বাস করতে হবে না, শুধু একটা গল্প শোনার মন নিয়ে আসতে হবে, আগুনের ঝলসানো বেগুনের ভর্তার মত জ্বলেপুড়ে যাওয়া, লঙ্কানুন মাখানো জীবনটাকে নিয়ে আসতে হবে। এটুকু পারা যাবে না? ওটুকুতেই হবে।