শনি-মঙ্গলবার করে গাছের তলা দিয়ে যেও না। ধরবে। গায়ে চাকা চাকা দাগ হবে। তারপর জলফোস্কা মত হবে। ফাটবে। রক্ত বেরোবে। অনেকে তো বাঁচেও না। যাবে? থাক, কাল সকালে যেও।
সকালে গেলেও হত। কিন্তু কলকাতা পৌঁছাতে বেলা হবে। রাতে বেরিয়ে গেলেই ভালো। নতুন জামাই। গ্রাম সম্বন্ধে জানেও না কিছু। এদিকে বউ, শাশুড়ি, আরো কেউ কেউ বারণই করছে, যেও না।
নতুন জামাই অবশেষে ঠিক করল যাবে। নইলে মালিকের মুখ ঝামটা। বিরক্ত লাগে। একবার মনে হয়েছিল থেকে যাবে, তবে সে ভয়ে না, ভালোবাসায়। কিন্তু সে ভালোবাসার টানও মালিকের মুখের কাছে ফিকে। বেরিয়েই গেল নতুন জামাই।
======
আজ পূর্ণিমা। বেশ চাঁদ উঠেছে। আঁকাবাঁকা গ্রামের রাস্তা। ধানক্ষেত পাশে। সামনে ওই অশ্বত্থ গাছটা নিয়েই গ্রামে যত কুসংস্কার। ভয়।
নতুন জামাই দেখতে দেখতে গাছটার কাছে এসে পড়ল। চারদিকে কেউ কোত্থাও নেই। নতুন জামাই বুঝতে পারছে তার একটা অস্বস্তি লাগছে। লাগারই কথা। এত শুনেছে বিয়ে হওয়া ইস্তক। কিন্তু কই? কিছু তো নেই কোথাও!
নতুন জামাই দাঁড়ালো গাছটার নীচে। মাথা তুলে তাকালো। ঘন ডালপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মাটির উপর পড়েছে, যেন কিত কিত খেলার ছক।
নতুন জামাইয়ের হাসি লাগল। এমন সুন্দর ছক তো সে নিজেও কাটতে পারত না। ছোটোবেলায় যৌথপরিবারে কেটেছে। ছেলে বলতে সে-ই একা। বাকি আটজন দিদিবোন। তার এক দাদা নাকি ছিল, জেঠুর বড় ছেলে, এগারো বছর বয়সেই সাপে কেটে মরেছে। তাকে মনে নেই নতুন জামাইয়ের। কিন্তু এত দিদিবোনের সঙ্গে বড় হয়েছে যে পুতুলখেলা, কিতকিত খেলা এইসব তার রক্তে মিশে। তার নিজের বিয়ের সময়েও সেই পুতুলের বিয়ের কথা মনে হচ্ছিল। কি ভালো লাগত তার। দিদিরা কনে সাজাতো। সে চন্দন বাটত। মালা গাঁথত। খেলতে খেলতে আসল নকলে গুলিয়ে যেত। নিজেকে মনে হত কনে। পলাশকে মনে হত তার বর। তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।
=======
হঠাৎ পলাশের কথাটা মাথায় কেন এলো?
পলাশ কখন মাথায় থাকে না?
পলাশের বিয়ে হয়ে গেছে। বুকের ভিতরটা জাঁতি দিয়ে সুপারির মত দুটো টুকরো করে দিয়ে গেছে সে। যেদিন সে বুঝল তার চোখ টানে পলাশের দিকে, তার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে পলাশকে মনে পড়ে, কখন দেখা হবে সেই ভাবনা আসে, বাড়ির কুলদেবতা গোবিন্দের পায়ে ফুল দিতে গিয়ে পলাশকে চেয়ে বসে….. সেদিন বুঝল সে জন্মপাপী। সমাজ জানে কে পাপী, কে পুণ্যবান।
নতুন জামাইয়ের চোখের কোণা চিকচিক করে উঠছে। পলাশের জাঁতিতে তার বুকের রক্ত লেগে। অন্তর্যামী জানেন।
নতুন জামাই চাঁদের আলোয় কাটা ছকটার দিকে তাকিয়ে। আশেপাশে তাকিয়ে একটা ছোটো ঢিল পেল। ব্যস, সেটা ছুঁড়ে শুরু করে দিল কিতকিত খেলা। গাছের পাতা দুলে উঠল। হাওয়া দিল ঠাণ্ডা শীতল একটা। কেউ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, কি ঠাকুরপো… পলাশকে চাই?... সে মিনসে তো মাগীর খোলা বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আনব ডেকে? কিগো ঠাকুরপো…. খেলবে তার সঙ্গে কিতকিত?
=======
চমকে উঠল নতুন জামাই। আর কারোর মুখে নিজের বুকের তলায় শেওলা জমা ভালোবাসার পাঁক উঠতে দেখে চমকে গেল। সে বলল, আনবে? পারবে? দেবে ওই মাগীর গলা টিপে….
গাছের ডালপালা ভেদ করে আবার উঠল খিলখিল হাসি… উফ… ঠাকুরপোর গোঁসা দেখো…. কেন ভাই… সে মাগীর দোষ কি…. সে মিনসে তোমায় এঁটো করে যদি একজন সরল সোজা মাগীকে ঠকায়…. তাতে মাগীটাকে মরতে হবে কেন… এ তোমার কেমন বিচার ঠাকুরপো…. হ্যাঁ গো…. তোমায় ঠাকুরঝি বলি?.... নাকি পলাশ তোমার সঙ্গে সোহাগ করার সময় যে নামে ডাকত….. দোলনচাঁপা…. সেই নামে ডাকি ঠাকুরঝি….
নতুন জামাই রাস্তায় দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে। ছি ছি…. এসব মুখে এনো না….. ছি ছি…. এ সব পাপ….
হাওয়া বলল, পাপ? ভালোবাসা পাপ? তার জন্য নিজের সব সুখ-শখ জলাঞ্জলি দিলে ঠাকুরঝি…. এই হরেনের মেয়েটাকেও বিয়ে করলে….. ঠকালে তো বলো…. অবিশ্যি সে পাপ আমি ধরি না… নিজেও তো কম ঠকোনি….. আমারও মনে ধরেছিল আমার ভাসুরের ছেলেকে ঠাকুরঝি….. আমার সোয়ামি ছিল বুড়োহাবড়া….. সন্দেহবাতিক ঘেন্না পুরুষ একটা… কিন্তু যতীন... আমার ভাসুরের ছেলেটা.... আমার মনে হয়েছিল, ও আমায় ভালোবেসেছিল জানো…. কিন্তু মানল না…. পেটে যখন বাচ্চা চলে এলো……
নতুন জামাই রাস্তায় শুয়ে। মুখের উপর এসে পড়েছে গাছের ফাঁক ছাঁচা চাঁদের আলো। তার গোটা শরীরের উপর কিতকিতের ছক। গাছের ভিতর থেকে সেই কণ্ঠস্বর বলে চলেছে…..
আমি ওই বাচ্চাপেটে এই গাছে ঝুলে পড়লাম ঠাকুরঝি….. তারপর ভোরে ওই হরেনদার বাবা…. হাগতে এসে আমায় দেখল…. চেঁচিয়ে সারা গ্রাম মাত করল….. যতীন একদিনও কাঁদল না জানো… একদিনও না….. আমি অবাক হলাম। এতটা ঠকলাম! তারপর থেকে তক্কে তক্কে থাকলাম। একদিন এই রাস্তা দিয়ে ফিরছে। অনেক রাত। তুমুল বৃষ্টি। আমি অনেকদিন ধরে এই কোটরে একটা কালাচ পুষছিলাম। দিলাম ওর পায়ের কাছে রেখে। দংশালো…. উফ…. ঠাকুরঝি…. এমন নেমকহারাম হৃদয়… যেন আমার পায়ে দংশালো ঠাকুরঝি….. আমি চীৎকার করে উঠে বললাম…. ওগো পালাও…. যাও নবীন ওঝার কাছে……
সে শুনল না। দৌড়ালো। পাগলের মত দৌড়ালো। বাড়ি গিয়ে খাটালের মধ্যে মরে পড়ে থাকল। আমি কাঁদলাম ঠাকুরঝি…. এক বছর কাঁদলাম। তারপর এই রাস্তা দিয়ে যখন ওকে নিয়ে যাচ্ছে সাজিয়ে চন্দনে, ফুলে….. আমার কি যে হল… সাপটাকে কুচি কুচি করে কেটে ওই গাঁদাচাষের মাঠে ছড়িয়ে এলাম। গাঁদাগুলোর গায়ে এখনও কালো ফুট দাগ হয়ে ঠাকুরঝি…. আমার কলঙ্কের মত….. নিজের পোষা ভালোবাসা, সাপ…. কিছুই রাখতে পারলাম না ঠাকুরঝি….. হৃদয়কে পুষতে নেই দোলানচাঁপা…. সব শেষ করে দেয়…..
======
নতুন জামাইকে ভোরে প্রথম দেখল গ্রামের নাপিত। পরনের ধুতিটা শাড়ির মত ঘোমটা দিয়ে পরা। ওই অশ্বত্থ গাছের গোড়া জড়িয়ে শুয়ে আছে।
ভুল ভাঙল কাছে গিয়ে। সাপে কেটে মরে পড়ে আছে। হাস্পাতালে বলল, কালাচ। তার আশেপাশে গাদাফুল ছড়িয়ে রেখেছিল কেউ। সেই ফুল জামাইয়ের মুখের মধ্যেও পাওয়া গেছে।
=====
তখন ভোর হব হব। প্রথম পাখি ডেকে উঠল। নতুন জামাই হঠাৎ মাথা উঁচু করে বলল, তুমি যদি সবটাই জানো, আমি কি করব বলো?
গাছ বলেছিল, মরণ…. সে আমি বলব? কিন্তু একটা কথা ভাব… পারবি এইভাবে বাঁচতে? শরীর আর হৃদয়কে দুই গাঁয়ে রেখে বাঁচতে পারবি?
নতুন জামাই বলেছিল, না।
গাছ সব ডালপালা মেলে চাঁদের দিকে…. বলেছিল…. চলে আয় তবে…..
(ছবি - গুগুল)