মানুষ অনেকভাবে একা হয়। আদর্শবোধে একা হয়। ঔচিত্যবোধে একা হয়। নীতিবোধে একা হয়। যন্ত্রণায় একা হয়। ভাবনায় একা হয়।
মানুষ অনেকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়। লোভে বিচ্ছিন্ন হয়। ঈর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়। আতঙ্কে বিচ্ছিন্ন হয়। আশঙ্কায় বিচ্ছিন্ন হয়। ষড়যন্ত্রে বিচ্ছিন্ন হয়। স্বার্থপরতায় বিচ্ছিন্ন হয়।
মানুষ এক হয় ভালোবাসায়, সহানুভূতিতে, অনুকম্পায়, সহমর্মিতায়।
এই যে প্রতিমূহুর্তে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। এই যে এতগুলো মানুষকে গুলি করা হল। এই যে এতগুলো মেয়েকে তুলে নেওয়া হল, এই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল, এই যে শুনছি। এই যে মানসিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। অসহ্য অসহায় লাগছে। এই যে বারবার নানাভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছি। বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। এই আমার ভবিতব্য। এই আমার শিক্ষার, বিশ্বাসের, অভিজ্ঞতার শাস্তি। মা, মেয়েকে বন্দুকের সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এই যে আমি স্নান করছি, খাচ্ছি, পড়াচ্ছি, কথা বলছি, লিখছি, শুতে যাচ্ছি - এ আমার শাস্তি। আমার উপার্জিত যন্ত্রণা। বিজ্ঞান আমার বোধের দরজায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে হাজার মাইল দূরের এক দেশকে। কিন্তু মানুষে মানুষে দূরত্ব তো মাইলে নয়। মানুষে মানুষে দূরত্ব শুধু আত্মপরতায়, তাকে না জানার অন্ধকারে। তাই পাশের মানুষও আমার অজ্ঞতায় থেকে যায় কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। মানুষের অসহায়তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার ইচ্ছা তো দেশ-কাল-ধর্ম-বিশ্বাস নিরপেক্ষভাবে এক। আমার অনুভবে তাই সব এক। দেশ-কাল-পাত্র ভেদ কই সেখানে?
আজ তাই যন্ত্রণায় এক হচ্ছি। মানুষের আয়ু কতটুকু? যে মানুষটা প্লেনের চাকায় পিষে নিজেকে অসময়ে শেষ করে দিল, তার একান্ত মানুষের মত বাঁচার ইচ্ছাকে কি আমি জানি না? সে ইচ্ছা কি আমার বুকের মধ্যেও অহরহ জেগে নেই? যে মানুষগুলোর দেহাবশেষ পাওয়া গেল প্লেনের গায়ে, তাদের সঙ্গে আমারও দেহাবশেষ লেগে, যে দেহকে আঘাত থেকে রক্ষা করি আমার সাধ্যে নেই।
মানুষের অর্জিত সম্পদ শুধুমাত্র ভালোবাসা। শুধুমাত্র অনুকম্পা। শুধুমাত্র সহানুভূতি। এর বাইরে মানুষ যা পায়, তা ফুরিয়ে যায়। তাকে আগলে রাখতে রাখতে সে সঙ্কীর্ণ, ক্ষুদ্র হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব হারায়। ক্ষমতা, সম্পদ, প্রতিপত্তিকে শকুনের মত আগলাতে আগলাতে মানুষ ভুলে যায় অবশেষে তার মানুষ হওয়ার কথা ছিল। নিজেকে বলিদান দেওয়ার কথা ছিল, অনেক মানুষের ভালোর জন্য। অনেক মানুষের মঙ্গলের জন্য। বলিদান দেওয়ার অর্থ মৃত্যুকে বরণ না। জীবনকে আলোর মধ্যে নিয়ে হাঁটা। সমস্ত ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতাকে ত্যাগ করা।
এই বিশ্বাস কি কোনোদিন ছাড়তে পারব? না পারব না। যদি বাকি জীবন এই চূড়ান্ত অমানবিক দৃশ্যাবলীর সাক্ষী থাকতে থাকতে পাগল হয়ে যেতে হয়, তবুও সেই আমার ভবিতব্য ধরে নেব। সব কাজ করতে করতে প্রতিদিন নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে ভাবব, এই আমার অর্জিত ধন - আমার মানসিক অত্যাচার। যে আমায় অত্যাচার করছে তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে আমায় অত্যাচার করার, তাতে আমার সমর্থন নেই, এইটুকুই সত্য শুধু।
শুরুতে অভিমান হয়েছিল, কেন মানুষ এই অমানবিকতাকেও সমর্থন করবে? আজ বুঝি, সে প্রশ্ন করার আমি কে? যার মনে হয় সেখানে যা হচ্ছে তা যথার্থ, তবে তার সঙ্গে আমি এক সারিতে দাঁড়াব না শুধু। কিন্তু তাকে শত্রু মনে করার কারণ দেখব না। না তো যারা সেখানে সে বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, মনে মনে বলব তারা শেষ হয়ে যাক। তারা শেষ হলেও কি এই অন্ধকার বিশ্বাস শেষ হয়ে যাবে? কোনোদিন যাবে না। শুধু চাইব তারা নিজেদের এভাবে সমস্ত জগতের শুভবুদ্ধি থেকে বিচ্ছিন্ন না করুক। জগতে ঘৃণ্যতম পাপ করার ক্ষমতা পাওয়া যায়, কিন্তু শুভ চেতনার সমর্থন পাওয়া যায় না। এই বোধ অবশেষে আসুক। এ আপাতত দুরূহ আশা হলেও, এই একান্ত চাওয়া। পৃথিবীতে এর উদাহরণও তো আছে। নইলে আজ এদেরকে নিঃশেষ করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? যাবে না। আজ যে নামে তাকে ডাকছি, কাল আরেক নামে সে আসবে। তবে আসবেই। তাকে শত্রু ভেবে নিজেকে সঙ্কুচিত করে ফল? সে বর্বরতা শত্রু। -ism টাই সমস্যা, -ist তো ফলাফল।
সংঘাতের রাস্তা যদি হত্যা হত, তবে এতদিনে সব পাপ পৃথিবী থেকে মুছে যেত। সব অপরাধীর কঙ্কালে পৃথিবী ঢেকে ফেললেও অপরাধ প্রবণতাকে নিঃশেষ করা কোনোদিন যাবে না। যায় না।
বুদ্ধ এক শপথ শিখিয়েছিলেন। সমস্ত অপরাধ, হিংসা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার মধ্যে আমি ধর্ম নিয়ে বাঁচব। বুদ্ধের শিক্ষার আলোয় যে সনাতন ধর্মের মূল কথা - হিংসার দ্বারা হিংসার নাশ হয় না, হিংসার নাশ হয় ভালোবাসায়। ভালোবাসা মানে সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, তিতিক্ষা। এই শক্তি। দুর্জনের অত্যাচার থামাতে যদি না পারি, তবে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে যাওয়া আমার প্রাপ্য। যতদিন না মানুষের চিত্তশুদ্ধ হয়। আলো আসে। আরো বেশি স্থৈর্য্য আসে। ধৈর্য্য আসে। বর্বরতার সামনে মনুষ্যত্বই একমাত্র চওড়া রাস্তা। তাদের হাতে প্রাণ/মান দেওয়ার চাইতে নিজেকে শেষ করে দেওয়া অনেক বেশি সম্মানের, যদি পৃথিবীর সমস্ত শুভশক্তি নিরুত্তর থাকে। তবে অত্যাচার করবে কার উপর? কোনো সাহায্য যদি না পাওয়া যায়, অন্তত নিজেকে অপমানিত হতে না দেওয়ার ক্ষমতা আমার হাত থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। লড়াইটা মানুষে মানুষে কোনোদিন হয় না, লড়াইটা হয় আলো আর অন্ধকারের। অন্ধকারকে নাশ করতে আলোই লাগে, আরো আলো।