পঁয়ত্রিশ বছরের আরতি যখন চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য এলো, বাহাত্তর বছরের কোমর ভাঙা সুশীলার মাথায় প্রথম যে বাক্যটা এসেছিল, “তোর হাড়মাস জ্বালিয়ে দেব রে মাগী।”
আরতির চা পছন্দ হল না। জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল নর্দমায়।
আরতির শাড়ির আর ব্লাউজের রঙ দেখে বলত, হাবাতের মত পছন্দ।
স্নান করানোর সময় আরতিকে বলত, দূরে দাঁড়া। খাওয়ার সময় আরতিকে বলত, তোর গায়ের গন্ধে বমি আসে। সরে দাঁড়া।
ছেলে বাইরে থেকে ফোন করত। রাতে। ছেলের দেশে তখন দিন। “মা একটু অ্যাডজাস্ট করে নাও। মাস ছয়েকের তো ব্যাপার।”
সুশীলা বলত, হ্যাঁ বাবা। এসব নিয়ে ভাবিস না। আমাকে তো জানিস। কত মানুষ নিয়ে সংসার করলাম বল।
কথা সত্য। সুশীলা বিয়ের পর থেকে প্রায় পঁচিশ বছর যৌথ পরিবারে কাটিয়েছে। সংসারের সব চাইতে শক্ত হাল ছিল সে। সব চাইতে বড় ছায়া দেওয়া মোটা গুঁড়ির গাছটা ছিল সে। তারপর সবাই আলাদা হল। সেও হল। ছেলে বিদেশ যাওয়ার মাস ছয়েকের মাথায় স্বামী চলে গেল। সুশীলা সেই থেকে ভীষণ অভিমানী। মুখরা।
=====
সেদিন বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। ফোন হাতে করে বসে সুশীলা। জানে তো আজ আসবে না মাগীটা। এক্ষুণি ফোন করবে নেকিয়ে…. মাসিমা আজ আর বেরোতে পারছি না…. যা বৃষ্টি…
কেন রে… এই বৃষ্টিতে বেরোয় না কেউ…. না বেরোলে গিলবি কী?
কলিংবেল বাজল। সুশীলা সেদিন আরতির খাওয়ার সময় দু'বার ওঠালো। কোনো দুর্বলতাকে আশ্রয় দেয় না সুশীলা।
দু'দিন পর। শরতের চাঁদ উঠেছে। গোটা না। নীচে অল্প একটু ভাঙা। আরতি সুশীলার চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, মাসিমা দেখো… আমার ছোটোটা বিস্কুট এরকম এক কামড় দিয়ে রেখে যেত…, হাসল আরতি।
সুশীলা মাথাটা ঘুরিয়ে তাকালো আরতির মুখের দিকে।
তার নাতিও তো এমন করে। একটা বিস্কুটে একটা কামড়।
আরতি ঘুমাচ্ছে। সুশীলা তাকিয়ে চাঁদের দিকে।
=====
মাস গড়িয়েছে তিন। সেদিন মাছওয়ালা এসেছে নীচে। রাস্তায়। বলছে খুব ভালো পমফ্রেট মাছ আছে…. নাও না…..
আরতি বলল, আমাদের বাড়ি কেউ খায় না গো….. চুনোমাছ আনলে এসো…. নেব।
সুশীলার ধাক্কা লাগল বুকে। যেন পাড় ভাঙল বানের জলে।
আরতিকে বলল, আমার সঙ্গেই খেতে বসিস।
আরতি বলল, আচ্ছা।
=====
মাস ঘুরেছে আট। অনেক ভালো সুশীলা এখন। কিন্তু? আরতির যাওয়ার সময় হল। কাজ নেবে অন্য বাড়ি। বাচ্চা দেখার কাজ। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই কাজে যায় নাকি।
সুশীলা ভাবে। কী করবে একা? ছেলে হিসাব করে টাকা পাঠায়। একাকীত্বের কোনো হিসাব হয় নাকি? তার জন্য টাকা দেবে? কোনোদিন না! ভয় লাগে সুশীলার। যদিও আরতি বলেছে, আসবে সে মাঝে মাঝে।
সবাই বলে, কেউ আসে না।
=====
আরতির কাজ ছাড়ার ছ'দিন আগে এলো জ্বর। ধুম জ্বর।
তার জায়গায় এলো নতুন লোক। কাবেরী। সুশীলা উদাস হল।
সেদিন রাতেও চাঁদ উঠেছে। এক কামড়ের চাঁদ। সুশীলা নিজেকে বলল, আজ... আজই…..
কাবেরী ঘুমাচ্ছে। তাকে ডিঙিয়ে উঠল। বাথরুমে গেল একা। ভীষণ পিছল যেদিকটা, সেদিকে হাঁটল ধীরে ধীরে। পড়ল পিছলে।
সুশীলা এভাবেই ভেঙেছিল কোমর। আজ কোমর ভাঙল না। জ্ঞান হারালো। ফিরল না আর।
আরতি এসেছিল। চন্দন মাখানো কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল, এমন বোকামি কেউ করে….