Skip to main content

গাছ থেকে নেমেই বদনের যেটা খেতে ইচ্ছা করল, সেটা হল সুজি। মা করত। গুড়ের সুজি। লাল। মাখা মাখা। 

     প্রচণ্ড গরম। গাছে উঠেছিল কেন মনে পড়ছে না। একটাও আম নেই। খানিক কাঠ পিঁপড়ের কামড় জুটেছে। খিদে পেয়েছে প্রচণ্ড। খাবে কি? 

     বদনকে কেউ কাজ দেয় না। কারণ বদন এক কাজ বেশিদিন করতে পারে না। সবাই বলে বদনের মাথায় গোলমাল। বদন বিশ্বাস করে না। কার না মাথায় গোলমাল? সে হিসাব দিতে গেলে গঙ্গার সব জল বয়ে সমুদ্দুরে গিয়ে পড়বে। থাক। 

     বদন কিছুক্ষণ গাছ তলায় বসল। সকাল থেকে চারবার গঙ্গাস্নান হয়ে গেছে। শিবের বাতাসা চারটে খেয়েছে। জল খেয়েছে দুই জালা। কিন্তু আবার খিদে পাচ্ছে। 

     বদন উঠল। সুজি কে দেয়? বদন জানে কাউকে চাইলেই তাড়াবে। কিন্তু সুজি না খেয়ে সে যাবে না। কোত্থাও যাবে না। অবশ্য যাবেই বা কোথায়?

     গ্রামে এলো। প্রায় পনেরো বাড়ি জিজ্ঞাসা করল। কেউ দিল না। বলে কাল করেছিলাম, পরশু করেছিলাম, আবার পরে করব, এই সব। 

     বদন বাড়ি চলে এলো। ঘরের অর্ধেক ছাদ ভাঙা। সেই অর্ধেকেই যতটা ছায়া হয় তাতেই সে দিনে শোয়। বৃষ্টি হলে শিবের মন্দিরে গিয়ে শোয়। 

     ঘুমিয়ে পড়ল কখন কে জানে। স্বপ্নে দেখল মা আর শিব তার জন্যে সুজি নিয়ে গঙ্গার ধারে বসে আছে। সে গিয়ে শিবের পাশে বসল। মা তাকে আর শিবকে সুজি বেড়ে দিল। পাতায় করে। লাল সুজি। 

     পেটটা মোচড় দিল। ঘুম ভাঙতেই কান্না পেলো। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল বদন। তারপর মুখ ধুতে গঙ্গায় নামল। বাড়ির সামনেই গঙ্গা। 

     এই বদন… বদন…

     রথীনের দাদু। রথীন আরবে কাজ করে। রথীনের দাদু একা থাকে। আগে কি সব ব্যবসা করত। বদনকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। ডাকে কেন? মারবে? 
রথীনের দাদু ডাকল। গাছ তলায় বসে। বিরাট অশ্বত্থ গাছ। এই গাছেই রথীনের বাবা গলায় দড়ি দিয়েছিল। কি ধারদেনা হয়েছিল। আর রথীনের মা বাপের বাড়ি চলে গেল। পাগল কি বদন একা নাকি? কেউ মরলে ধার শোধ হয়? 

     বদন সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রথীনের দাদু তাকে পাশে বসতে বলল। 

     বদন বলল, তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যাভার কেন করছ গো জেঠু? শরীর খারাপ? 

     রথীনের দাদু বলল, আরে বস না…. বলচি..

     বদন একটু দূরত্ব রেখে বসল। খিদে পাচ্ছে। জোর খিদে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে গাছের পাতাগুলো চিবিয়ে খায়। 

     আমার ছেলেটা রোজ রাতে আমার বিছানার পাশে এসে বসে। আমার ভয় লাগে বদন। তুই আমার সঙ্গে রাতে একটু শুবি? 

     কেন বুড়োদা আসে কেন? বদনের অবাক লাগল শুনে।

     সে আমি জানি না বদন। খালি ভয় দেখায় আর বলে তুমি টাকা ক'টা দিলে আমার ধার শোধ হয়ে যেত। আমায় মরতে হত না। 

     তা তুমি দাওনি কেন?

     আরে আমার ওই টাকাক’টা বুড়ো বয়সের সম্বল না… দেয়? আমার সব যাবে….

     বদন চিন্তিত মুখে বলল, তাও ঠিক। আচ্ছা শোবো। কিন্তু কি দেবে?

     রথীনের দাদু বলল, কি আর দেব, খাবি আমার সঙ্গে… এখানে সেখানে ভিক্ষা করে বেড়াতে হবে না…..

     রথীনের দাদু চলে গেল। বদন বসে থাকল গাছের নীচে। বুড়োদা সত্যিই আসে?

     আসি তো…

     একটা গলা। বুড়োদার তো…

     বদন বলল, কেন আসো? কই তুমি?

     বুড়ো বলল, দেখে কাজ নেই। এমনিই তোর মাথার ঠিক নেই তার উপরে দিন দুপুরে ভূত দেখে আরো বিগড়াক। 

     বদন বলল, সে ভালো… কি থেকে কি হয়ে যায় বলা তো যায় না…. তা তুমি মরে ভালো আছ তো? 

     বুড়ো বলল, সে আছি। শোন তুই রাতে গেলে কিন্তু তোর ঘাড় মটকে দেব… বাবাকে ভয় দেখিয়ে আমি কিছু টাকা বার করতে পারি নাকি দেখি….

     বদন বলল, হায় রে… মরেও টাকা লাগবে তোমার? ওখানেও ধার? 

     মাথায় চাঁটি পড়ল। 

     যা বুঝিস না তা নিয়ে বকবি না। ওই টাকাগুলো নিয়ে বাবা কি করবে বল তো… সব তো পচবে… কাউকে নমিনি করেনি… পাছে ওকে মেরে টাকা নিয়ে নেয়.. সেই ভয়ে… এত পাজি…

     বদন বলল, কাউকে নিন্দা করতে নেই। যার টাকা সে যা খুশি করুক। তোমার তাতে কি? 

     আবার চাঁটি। 

     যার টাকা মানে? আমার বাপের টাকা… যা হোক শোন… টাকাটা আমি আজ না হয় কাল বার করবই… তুই একটা কাজ করতে পারবি?...

     আগে শুনি। 

     বদন দেখল মানুষের সঙ্গে বুদ্ধিমানের মত কথা না বললেও ভূতের সঙ্গে বেশ বুদ্ধিটা খুলেছে তো! 

     টাকাটা নিয়ে রাতে শিব মন্দিরে আসবি। মানসী আসবে। ওকে দিয়ে দিবি। 

     তোমার বউয়ের নাম তো সন্ধ্যা না? 

     আবার চাঁটি। 

     ওরে মানসী আমার হবু ছেলের বউয়ের নাম। ওকে বাবু ভালোবাসে। আমি ওদের কথা শুনি রোজ। 

     সেটা ভালো নয়… ভূত বলে যেখানে সেখানে আড়ি পাতবে? 

     আবার চাঁটি… 

     না হলে জানব কি করে আজ গোবিন্দ ওঝার বাড়ি গুড়ের সুজি হয়েছে?...

     বদন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল…. তাই? যাই তবে…

     ওহ, গেলেই যেন পাত পেড়ে খাওয়াবে রে হতভাগা তোকে…. এই নে… আমি এনেছি…

     হঠাৎ একটা শালপাতায় বদনের সামনে লাল সুজি চলে এলো। আহা কি গন্ধ… আবার কাজু কিসমিস দেওয়া…

     বদন খেতে বসে গেল। আনন্দে তার চোখের থেকে কয়েক বিন্দু জল সুজিতে পড়ে একটু নোনতা লাগল। সে ভালো। গরীবের জিভে এত স্বাদ ভালো নয়। 

     বুড়ো বলল, শোন, আমি রোজ তোকে এখানে খাবার এনে দেব… আর মানসীকে টাকাটা দেওয়ার পর ওর থেকে কিছু টাকা দিয়ে ঘরটা বানা… মানুষের মত থাক…
বদন বলল, কিন্তু তুমি আমার জন্যে এত করবে কেন? আমি যে পাগল….

     বুড়ো বলল, মরার পর থেকে তোকে দেখি আর ভাবি, কি ভুলটাই করলাম রে…. মানুষ যদ্দিন ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে তদ্দিন তার জীবনে শান্তি নেই রে…. তোকে দেখে শিখলাম…. ভবিষ্যতে যা হবে দেখে নেওয়া যাবে… এইটাই ভালো….

     তাই তো গো… তোমাকে আর আমার ঘর বানাবার টাকা দিয়ে লাভ নেই… আমার শুনেই কেমন ভয় করছে… তুমি বরং আমায় মাঝে মাঝে কিছু খাইয়ো… ঠিকাছে? 

     আরে! কখন যে মেঘ করেছে বদন খেয়ালই করেনি। হুড়মুড় করে চারদিক কালো করে বৃষ্টি নেমে গেলো। 

     বদন দৌড়ে শিব মন্দিরে এসে ঢুকল। কেউ নেই ফাঁকা। বদনের মনে দারুণ আনন্দ। এত্ত ভালো সুজি সে কোনোদিন খায়নি। ঘুম চলে এলো। বদন স্বপ্ন দেখছে, শিব সে আর বুড়োদা তার বাড়ির অর্ধেক ছাদে বসে চাঁদ দেখছে। আর তার মা উঠানে খিচুড়ি রাঁধছে। সে খিচুড়ির গন্ধ পেয়ে চাঁদের বুড়ি বলছে, আমার জন্যে একটু রেখো বউমা। 
     তার মা রাঁধতে রাঁধতে বলল, আচ্ছা মা। 

     ঘুম ভেঙে গেলো। আকাশে এত্ত বড় চাঁদ। মা কই? 

     মন খারাপ হয়ে গেল বদনের। যদিও জানে মা এখানেই কোথাও আছে, আবার তার ঘুমের মধ্যে চলে আসবে। তাই ডাকল, মা? 

     সাড়া এলো না। আবার ডাকল, ও মা.. মা…

     একটা বেড়াল ঢুকলো, সঙ্গে তার তিনটে বাচ্চা। বদন হাততালি দিয়ে বলল… এই তো… এই তো…

     বাইরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বুড়োদার। বলল, তুই ঠিক বদন.... ভেবে ভেবেই আমি শেষ হয়ে গেলাম....

     বদন শোনেনি। সে তখন বেড়ালের বাচ্চা আদর করতে ব্যস্ত।