- মশায়, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছেন?
- না, হাওড়ার ব্রীজের উপর বামাখ্যাপা চড়ে বসে মা মা করছেন, তাই দেকচি... যত্তোসব…
- আহা, চটেন কেন? চা কি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে?
- কেন?
- না, চুমুক দিচ্ছেন না, হাতে ধরে বসে আছেন, তাই…
- প্রথম কথা এটা চা নয়, কফি, দ্বিতীয়ত এটা ঠাণ্ডা হয়নি…
- এখন চাইলে দেবে?
- আমায় জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আমি কি ট্যুর ম্যানেজার?
- আপনি কি খুব রাগী?
- না, আপনি সেই শিয়ালদা থেকে আমার মাথাটা খাচ্ছেন…
- খাওয়ার মত কিছু আছে কি?
(নিরুত্তর)
- আসলে দেখুন, আপনি আর আমি ছাড়া সবাই পরিবার নিয়ে এসেছে... আপনার বউ বিদেশে চাকরি করে, আমার বউ স্বর্গে কি করে জানি না... তাই একা একা তো আর ঘোরা যায় না... মেয়ে জোর করে পাঠালো তাই এলাম... নইলে সরকারি দপ্তরে আর কবে কাজের অভাব হল যে…
- বসুন…
- আসলে উনি আপনার সঙ্গে আসেননি বলে আপনার মধ্যে একটা অভিমান জন্মেছে…
- কিছুটা তাই... আসলে আমি কোনোদিনও ওর প্রায়োরিটিতে পড়ি না…
- হুম... সব কিছু পরিবর্তনশীল, মানে প্রবহমান মানেন তো? এও পরিবর্তন হয়ে যাবে…
- সেই…
- আপনি ব্যাপারটা দেখুন... এই যে আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে স্থির বসে আছেন... ভাবুন এই ‘স্থির’ চিত্রপটটা কতটা মিথ্যা…
- কেন?
- দেখুন, আপনার অস্তিত্বটাকে প্রতি মুহূর্তে বাঁচিয়ে রাখতে শরীরে কত জটিল একটা সিস্টেম নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে... এই যে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আপনি স্থির দেখছেন, অথচ প্রতি মুহুর্তে আলোকরশ্মি ওর থেকে প্রতিফলিত হয়ে আপনার চোখে পড়ছে বলেই যে না আপনি ওকে স্থির দেখছেন... মানে যা কিছুকেই আমরা ধ্রুব বলছি, আসলে সেটা একটা ধারাবাহিকতার রূপ... আপাতভাবে স্থির…
- যান, কফি নিয়ে আসুন, আপনার ভাবনাটা ভালোই লাগল... এত গভীরে ভাবেন যদি সারাদিন ওরকম আবোল তাবোল বকেন কেন?
- যাতে আসল ভাবনাগুলো বেরিয়ে না যায়, বুঝলেন…
২
===
- এলাম, বসি?
- বসুন, আগে এসেছেন দার্জিলিং?
- এসেছি, পরমাকে নিয়েই চারবার। এই সব জায়গায় ওর স্মৃতি। আমায় মজিয়ে ছাড়ছে। নেচার চাইছে আমি কাঁদি। কিন্তু আমি কাঁদব না, কেন বলুন তো মশায়?
- কেন?
- কারণ ওগুলো পাস্ট। আমার কিছু নার্ভসেল ওগুলোকে নানা রসায়নে চুবিয়ে আমার কাছে জ্যান্ত করে রেখেছে... ওই যে চায়ের দোকানটার পাশের গাছটা... ওখানে আমরা ছবি তুলেছিলাম.. ওই গাছটার ওসব কথা মনে আছে? নেই। কেন বলুন তো? কারণ ওর নার্ভাস সিস্টেম নেই…
- আশ্চর্য ভাবনা আপনার…
- তা বটে। কিন্তু আপনি দেখুন, আমি কেন একটা অতীতকে মনের রসায়নে চুবিয়ে জ্যান্ত করে রেখে দেব? এটা স্টুপিডিটি নয়?
- হবে হয় তো... কিন্তু অতীতেও তো বাঁচে মানুষ…
- বাঙালিকে কি আর সে কথা আলাদা করে শেখাতে হয় মশায়? আমাদের মনের অর্ধেকটা জুড়েই তো পাস্টের সেন্টিমেন্টালিজম…
- সেই…
- বাইবেলে আছে ঈশ্বর নাকি আমাদের নিজের ছাঁচে বানিয়েছে... গীতাতেও আছে যে আমরা নাকি ওঁর পার্টস... মানে বস্তুগত এক, মাত্রাগত আলাদা... এক মাটি... আমরা হলাম ছোটো প্রদীপ... তিনি হলেন পাহাড়... আপনার কি মনে হয় ঈশ্বরের নার্ভাস সিস্টেম আছে?
- আমি অ্যাগনোস্টিক... মানে অজ্ঞেয়বাদী…
- বুঝলাম। আচ্ছা, এভাবে ভাবুন, আপনার কি মনে হয় যে মানুষ ছাড়া আর কোনো অতিজাগতিক অস্তিত্বে এরকম নার্ভাস সিস্টেম আছে, যে এত গভীর সুক্ষ্ম সংবেদনশীল?
- জানি না, তবে মানুষের সমষ্টি চেতনা বলে কিছু একটা হয় তো।
- কিচ্ছু হয় না। এই যে কিছু মানুষ জিজ্ঞাসা করে বেড়ান খ্রীষ্ট, রাম, কৃষ্ণ সত্যি ছিলেন কি না... ভাবটা এমন যেন সত্যি ছিলেন জানা গেলেই তারা ওদের বলা সব কথাগুলো মেনে চলবে... ব্যাপারটা তো তা নয়। ওরা সত্যি ছিলেন কি না ছিলেন সেটা জেনে দল পাকাতে বরং আরও সুবিধা হবে।
- তা যা বলেছেন।
- আপনি টলস্টয়ের কথা পড়েছেন তো? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আমার আছে, সেই সম্পর্কের খোঁজকেই বলে ধর্ম... এ কবিত্ব ছাড়া কি?
- সে ঠিক, চারদিকে তো ধর্ম মানে ইন্ডাস্ট্রি হয়ে দাঁড়িয়েছে... এক একজন অবতার যেন এক একজন পেটেন্ট হোল্ডার... বা সিইও…
- যা বলেছেন, ধর্মের মধ্যে থেকে কবিত্বটা বাদ দিলে যা পড়ে থাকে সে অসার... ছাইভস্ম…
- ঠিক…
- তো যেটা বলছিলাম... এ সম্পর্ক তৈরির দায় কার? আমারই তো। এরপরের কথা হল নিজের সঙ্গে নিজের একটা সম্পর্ক তৈরি করা... মন আর শরীর নিংড়ে সুখ খুঁজে বেড়াব বলেই কি এই জগতে আসা দাদা? এর বাইরে কি কিছুই নেই?
- কেন, বুদ্ধি দিয়ে জগতের নানা তত্ত্ব খোঁজা…
- সেও হয়, তবে কি জানেন দাদা, মানুষের আসলে দুই অবস্থা, এক অন্তর্মুখ, দুই বহির্মুখ। মানুষের গভীরের যত তত্ত্ব, সে বিজ্ঞান হোক, কি অধ্যাত্মবোধ... নিজের গভীরে গিয়েই তো তার সূত্র আবিষ্কার... নিজেকে না মন্থন করে না পাওয়া যায় মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব না ব্রহ্মতত্ত্ব। কথা হল নিজেকে মন্থন করে তত্ত্ব চাই, না নিজেকে নিংড়ে সুখ? প্রথমটায় পরম আনন্দ। দ্বিতীয়টায় নিজেকে ক্রমে ছিবড়ে করে ফেলা অবশেষে।
- ওহ্, আপনারা দু’জন এইখানে... আমি তো... মুড খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে? কি হয়েছে?
- আরে মশায়, মিত্তিরদার কাল থেকে হচ্ছে না... শক্ত, মানে ইট... বুঝলেন…
- তাই নাকি মিত্তির মশায়?
- ছাড়ুন তো... হালদারবাবুর যত গোলমেলে কথা…
- বেশ... আজকে রাতে চৌধুরীদার রুমে আয়োজন চলছে... মহিলারাও অ্যালাওড... মায় চক্কোতি বলছেন বউ বদল খেলাও চলতে পারে... মানে সুইপিং... জানেন তো...
মিত্তির মশায় উঠে, কোমরটা ছাড়িয়ে বললেন, আচ্ছা হালদারদা, এই নীতিবোধ বা মর্যালিটি নিয়ে আপনার কি বক্তব্য? সেটা কি নিছক সামাজিক একটা প্রথা নাকি সেটা এক্সিস্ট করে?
হালদার বললেন, সেটা ডিপেণ্ড করে আপনি কিসের নেশায় কতটা ডুবে আছেন... মান, খ্যাতি, স্কচ, রাম, ধর্ম... সব নেশা দাদা, সব... নেশা ছুটলে কি আর মানুষ এ মানুষ থাকে দাদা... এ মানুষে সে মানুষ আছে…
মিত্তির মশায় বললেন, লালন, আহা... ভারী চমৎকার গলা তো আপনার... গানটা চলুক…
হালদার গান ধরলেন…
এই মানুষে সেই মানুষ আছে
কত মুনি-ঋষি যোগী-তপস্বী তারে খুঁজে বেড়াচ্ছে।।
জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরতে গেলে হাতে কে পায়
আলেক মানুষ অমনি সদাই
আছে আলেকে বসে।।
অচিনদলে বসতি যার
দ্বিদল পদ্মে বারাম তার
দল নিরূপণ হবে যাহার
সে রূপ দেখবে অনাসে।।
আমার হল বিভ্রান্তি মন
বাইরে খুঁজি সাঁই কয় ঘুরবি লালন
আত্মতত্ত্ব না বুঝে।।