মেঘ
=====
মেঘের মধ্যে পাহাড়, না পাহাড়ের মধ্যে মেঘ? থেকে থেকেই মুষলধারে নামছে বৃষ্টি, স্নান করে যাচ্ছে দার্জিলিং।
এই ভরা শ্রাবণে কেউ পাহাড়ে যায়?
বাড়ির লোক, স্বজন পরিজন, বন্ধুবান্ধব --- সব্বাই বারণ করল, সাবধান করল। কিন্তু পাহাড়ে তো আমাকে যেতেই হবে, বুকে জমেছে শোকের পর শোক। ব্যথার পরে ব্যথা। পাহাড় শোক হরণ করে। এ আমার গভীর বিশ্বাস। যাব না পাহাড়ের কাছে? নিজেকে উন্মুক্ত করে দাঁড়াব আর কার কাছে?
শনিবার বেলায় পদাতিক এক্সপ্রেস এসে দাঁড়ালো নিউ জলপাইগুড়ি। স্বস্তি। এরপর তো অল্পখানিক পথ। পথে যেতে যেতেই বদলে যাবে সব। বদলে যাব আমিও। জ্বলন্ত চিতায় পড়বে শান্তিজল। আমি আসছি।
শুরু হল গাড়ির দর নিয়ে হাঁকাহাঁকি। কেউ বলে চার হাজার, কেউ বলে পাঁচ, কেউ বলে ছয়। সঙ্গী কয়েকজন কথা বলছে। ঠিক হল শিলিগুড়ি থেকে হবে ওঠা। তাই হোক। যাত্রা হোক শুরু। আর ধৈর্য রাখা দায়!
ড্রাইভার বললেন, যে রাস্তা দিয়ে উঠব, তার নাম রোহিণী। আরোহী শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। বেশ। আরোহী তো বটেই। আরোহীর আবার লিঙ্গভেদ! উদ্দেশ্যভেদ হতে পারে। মানুষের হাঁটার কত উদ্দেশ্য। কতজন গন্তব্যে পৌঁছায় কে তার হিসাব রাখে? লক্ষ্যে পৌঁছে অনেকে বুঝতে পারে এ তার গন্তব্য ছিল না। কেউ নিজেকে মানিয়ে নেয়। কেউ পারে না, হারিয়ে যায়।
কার্শিয়াং-এর পর থেকে মেঘ শুরু হল। দার্জিলিং-এ যখন ঢুকছি তখন বৃষ্টি সদ্য নিজেকে গুছিয়ে নামার জন্য তোড়জোড় করছে। গাড়ি থেকে নেমে ম্যাল ঠেঙিয়ে, লটবহর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন এসে হোটেলে পৌঁছালাম তখন নেমে গেছে তুমুল বৃষ্টি। জানলা খুলে দিলাম। বুকের ভিতরে দীর্ঘদিন আটকে থাকা পাল্লা হুস্ করে খুলে গেল। শান্ত হতে হবে। পাহাড় শান্ত করে নেবে। পাহাড় শোক নিয়ে নেবে।
তীর্থ
======
পরের দিন চোদ্দোই অগাস্ট, রবিবার। ম্যাল জুড়ে চলছে আসন্ন পনেরোই অগাস্টের মহড়া। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। হাতে পুজোর ডালা নিয়ে কোথায় যায় সবাই? মহাকালের মন্দির। যাই।
কয়েক পাক হেঁটে বুঝলাম মহাকাল আসার রাস্তা প্রশস্ত করেননি মোটেই। মহাকালের দরজায় পৌঁছাবার রাস্তা অবশ্য মানুষ বেশ কঠিন করে নিতেই ভালোবেসেছে। নইলে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ ইত্যাদি ইত্যাদি মানুষ যায় কেন? সে যাত্রার নাম রেখেছে তীর্থ। মানুষের ত্যাগের উপর কোথাও একটা তৃষ্ণা তো থাকেই। হৃদয় আঁকড়ে রাখতে চায়, বুদ্ধি তার দীর্ঘদিনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে বলে, থাকবে না। বুদ্ধিই জয়ী হয়। হৃদয় ভাঙে, আবার জোড়ে। এই ভাঙা আর জোড়া চলতে চলতে হৃদয়ের মধ্যে একটা পথ তৈরি হয় - বৈরাগ্যের পথ। সে পথ প্রথমে চিড়ের দাগের মত সরু হয়। ক্রমে চওড়া হতে শুরু করে কারো কারো জীবনে। সে তখন সংসারকে আর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞাতেই বাঁধতে পারে না। সে আর কিছুতেই নিজেকেও বাঁধতে পারে না। সে বুদ্ধিকে বলে, তুমি ঠিক ছিলে। এই আমি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম, এবার?
বুদ্ধি বলে, এবার উত্তীর্ণ হও।
এই 'উত্তীর্ণ হও' কথাটার স্পষ্ট যে কি মানে হৃদয় জানে না। কিন্তু এটুকু বোঝে কথাটার ইঙ্গিত সে বোঝে। 'প্রেয়'কে ছেড়ে 'শ্রেয়'র রাস্তায় পা বাড়ায়। রাস্তা হয় কঠিন। সে কঠিন রাস্তার যাত্রাকে সে বলে তীর্থ।
মহাকালের মন্দিরে ওঠার আগে বড় একটা চাতাল। উপরে ছাওনি দেওয়া। বিক্রি হচ্ছে পুজো দেওয়ার নানা উপকরণ। আরেকটু দূরে তাকালে চারদিকে সবুজ আর সবুজ। বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এবার আবার ওঠার পালা। বাঁক ঘুরতেই শিরডির সাঁই বাবার মন্দির। তারপর আরো উঠতেই নানা মন্দির। বড় মন্দিরটা মহাকালের। প্রণাম করে পাশের মন্দিরে ঢুকতেই পুরোহিত ঝরঝরে সংস্কৃতে চণ্ডীর স্তব আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন। কানে বাজছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ। বাইরে বৃষ্টির শব্দ, মন্দিরের ভিতরে চণ্ডীর স্তব। সামনে সিংহবাহিনী। মানশ্চক্ষে রেডিও। আশেপাশে কত মানুষজন। মহালয়ার সকাল। সব হারিয়ে গেল। মানুষগুলো সমেত আমার গোটা মহালয়া চলে গেছে মা!
স্তব পড়া হচ্ছে, মা তোমায় যে আশ্রয় করে গোটা জগতের আশ্রয় হয় সে।
হবে না?! মা ডাক ছাড়া আর আশ্রয় কোথায়? বাকি সব আশ্রয় তো বানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু মা ডাকের আশ্রয় তো মা ছেড়ে গেলেও থেকে যায়। কান্নায়।
স্তব পড়া হচ্ছে, মা প্রসন্ন হও, মা প্রসন্ন হও... জগতকে পরিপালন করো। এই জায়গায় এসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নিজে কাঁদেন, আপামর বাঙালিকে কাঁদান। বাঙালি কাঁদে, মায়ের জন্যে কাঁদে। দক্ষিণেশ্বরে, তারাপীঠে, রামপ্রসাদের ভিটেতে, কালীঘাটে, জয়রামবাটিতে বাঙালি মায়ের জন্যে কাঁদে।
নেমে এলাম। চাতালে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখলাম স্থানীয় মানুষদের নিষ্ঠা, ভক্তি। আশ্রয়ের জন্য আকুলতা।
একটা ভিজে কুকুর পায়ের কাছে এসে বসল। চোখের ভিতর দিয়ে এমন তাকাতে কুকুর ছাড়া আর কে পারে? আদর আর পার্লেজি, এইটুকু তো চাহিদা। দেওয়া যায় না? যায় যায়। দিতে চাইলে দেওয়া যায় না? অনেক কিছু দেওয়া যায়। নিজেকেও দেওয়া যায়। নেবে কে? সোনার তরীতে ওঠার জায়গা হয়নি রবীন্দ্রনাথেরই…
হিমালয়
=========
টয়ট্রেনে উঠতে হবে। সঙ্গী আছে অনেক কচিকাঁচা। তাদের উদ্দেশ্য করে নিজের শখটাও পূরণ করে নিতে হবে। বৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে বুঝে গেছি এখানের ছাতার বপু কেন আমাদের সমতলের চাইতে এত বড়। অমন চওড়া ছাতি না হলে এমন পাহাড়ে উদ্দাম বৃষ্টির হাত থেকে কে রক্ষা করবে বাপু হে! কিনব? থাক। আর তো দুটো দিন। ভিজিই না হয়।
দার্জিলিং স্টেশান। যথেষ্ট ভিড়। লাইন টপকে টপকে ছাতা মাথায় দাঁড়ালাম ধারে এসে। বৃষ্টিতে অর্ধেক ভিজতে ভিজতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামা বাড়ি দেখছি। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোর কথা মনে পড়ছে। পাহাড় ভালোবাসতেন। সে মংপু হোক, চাই দার্জিলিং। ছিন্নপত্রের চিঠিতে সেই লটবহর নিয়ে দার্জিলিং আসার বর্ণনা মনে পড়ছে, হাসি পাচ্ছে। একবার পুজোর আগে দার্জিলিং মেলে রিজার্ভেশান না পাওয়া জন্য আসা স্থগিত রাখতে হচ্ছে, চিঠিতে সেও জানাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন বাবার সঙ্গে হিমালয়ের কোলে কাটিয়েছেন ছোটোবেলায়। হিমালয়ের একটা শাখাই কি ক্রমে গ্রাস করেছিল সেই শিশু রবীন্দ্রনাথকে? নইলে আজীবন এত মানুষের শোক হরণ করে আসছেন কি করে? রবীন্দ্রনাথ কি বুকে করে নিয়ে বেড়াতেন হিমালয়কে? না কি হিমালয় বুকে করে নিয়ে বেড়াত তাঁকে?
ট্রেন ছাড়ল। বৃষ্টি পড়ছে ছাদ জুড়ে। কাঁপতে কাঁপতে তিনটে বগি চলছে। চারদিকে কাঁচ দেওয়া। চলন্ত ছাদ দেখতে পাওয়া ভীষণ সুখের। মেঘলা আকাশ অবাধ্য। স্থির। ছাদ সরে যায়, আকাশ সরে না। গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ে আছে ট্রেনের ছাদে। স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে তুমি মেঘ না কুয়াশা?
বাতাসিয়া লুপ গেল। নামা গেল না। দারুণ বৃষ্টি। ঘুম স্টেশান। বৃষ্টি ধরেছে। রেলের মিউজিয়াম মুগ্ধ করল। কিভাবে কিভাবে রেল লাইন পাতা হয়েছিল সে ছবি দেখে তাজ্জব লাগবেই! আরো আশ্চয্যির কথা যার প্রথম মনে হয়েছিল এই পাহাড়ে সমতল থেকে একখানা রেললাইন পাতা যেতে পারে! কি স্পর্ধা মানুষের স্বপ্নের। ইচ্ছার। বাসনার।
দার্জিলিং স্টেশানে নেমে আবার হাঁটা। আবার ভেজা। এবার একটু বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ভেজা। আর একটাই তো দিন। সামনের সোমবারটা। মঙ্গলবার তো নেমে যেতে হবে। ছুটি ফুরিয়ে আসছে যে!
সন্ধ্যে নেমে গেছে। কফির দোকানে বসে। রাস্তায় তিস্তা, গঙ্গা, যমুনা সব বইছে। বৃষ্টির জলের ধারা দেখলেই মনে হয় স্কুলছুট বাচ্চাদের হইহই করে বাড়ি ফেরা। রাস্তার ঢাল বেয়ে নামা জল যেন বলছে, ওহে নৌকা বানানো মনে আছে? সব ভুলেছ! আগে কি সুন্দর নিজের হাতে নৌকা গড়ে হাওড়ার ওই এঁদো গলির বড় নর্দমায় অবধি ভাসিয়েছ, মনে আছে? আর আজ? শুধু জমাতে শিখেছ। কিছুই আর নিজের হাতে করে ভাসাও না।
কেন বৃষ্টি, ভাসিয়েছি তো? আগুনে না-পোড়া নাভি! প্রিয়জনের। একবার তো নয়, বারবার!
বৃষ্টি বলল, চুপ করো, চুপ করো নিষ্ঠুর! নরম হও, স্নিগ্ধ হও, শান্ত হও। এত আত্মকেন্দ্রিক কেন?
সাইটসিন
========
সোমবার ভোর। আবার এলাম মন্দিরে। কিন্তু আজ সব অন্যরকম। মনে পড়ল আজ শ্রাবণের শেষ সোমবার। প্রচুর লোকজন। ভোগ দেওয়া হচ্ছে। খিচুড়ি, পায়েস, গোল বলয়াকার কি মিষ্টি একটা আর আলুর তরকারি। বেশ স্বাদ। আশ্চর্য লাগল যেটা, এত এত মানুষ, কেউ কাউকে বকাবকি করছে না, কোনো ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে না। সবাই লাইন দিচ্ছে, পুজো দিতে উঠছে, ভোগের লাইনে দাঁড়াচ্ছে, ভোগ নিচ্ছে। এত মানুষের প্রসন্ন মুখ একসঙ্গে দেখতে পাওয়াটাই কি কম চিত্তপ্রসাদ! বৃষ্টি কম। আচমকা পাইনের সার ভেদ করে রোদ এসে পড়ল চাতালে! নীল আকাশ। খানিক বিরাম বৃষ্টির। এও ভালো। এও সুখ।
আগামীকাল ফেরা। আজ কথা হল চারদিকটা একটু ঘুরে নিতে হবে। বেড়াতে এসে চারদিক ঘুরতে যাওয়াটা একটা কর্তব্য। ইংরাজিতে যাকে বলে, সাইটসিন। এখন কোনো সাইট যে কার জন্য সত্যিকারের সাইট এ আমি আজও ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। আমার ক্ষেত্রে বিশেষ করে দেখেছি যে যায়গায় নিয়ে গিয়ে বলেছে এই হল গিয়ে একটা বিখ্যাত সাইট, দেখো। আমি সেখানেই দেখার কিছু পাইনি। কিন্তু রাস্তায় যেতে যেতে এমন অনামী গ্রাম, মোড়, গাছ, নদীর বাঁক, কোনো বাচ্চার হাসি দেখেছি, সেই হয়েছে আমার সাইটসিন।
নানা মনেস্ট্রি ঘুরে বিকেলে এলাম নিবেদিতার বাড়ি। ঘরের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকতে ভালো লাগল না। একজন মহারাজ ফোন হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমার এক সঙ্গী কাউকে আশেপাশে না দেখতে পেয়ে তাকেই টয়েলেটের দিক নির্দেশ চাইতে বেশ একটা ঝাঁঝালো উত্তর পেলেন। বন্ধুটি মিশন-টিশনে যান না তেমন, অগত্যা এ অভিজ্ঞতা নতুন। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন উনি অমন রেগে গেলেন কেন? আমি বললুম, আহা, যার কাছে মানুষ পরপারের দিশা জানতে আসে, তার কাছে তুমি শৌচালয়ের দিশা জানতে গেলে তিনি চটবেন না? বিলক্ষণ চটবেন? মায় নিবেদিতাকেই কম নাস্তানাবুদ করেছেন এনারা সে সময়ে? তিনি ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন বলে কি প্রবল দণ্ডই না তাঁকে পোহাতে হয়েছে! যাক বাপু, ইতিহাস মনে রাখলে অনেকেরই ভক্তিতে গোলমাল হবে। ইতিহাস বড় নির্মম। ভুলে যাও। ভক্ত হও।
কাঞ্চনজঙ্ঘা
=============
আচমকা মেঘ সরিয়ে সন্ধ্যবেলা চাঁদ এসে দাঁড়ালো দার্জিলিং এর আকাশে। কি অসহ্য সুন্দর হতে পারে সে নিজের চোখে না দেখলে হয় তো বর্ণনা করা যায় না। নীচে সার দেওয়া আলোর মালা। আকাশে এক হাতে মেঘকে সরিয়ে চাঁদ এসে দাঁড়িয়েছে নিত্য অতিথির মত।
সারারাত ঘুম হল না। হোটেলের ছাদে বৃষ্টির আওয়াজ শুনছি। এক-একসময় ভয়ও লাগছে। সবশুদ্ধ ধসে পড়বে না তো? বাড়িগুলো তো সব দেখি ধার দিয়ে দিয়ে ঝুলছে। আর হোটেলে প্রবেশ মানেও তো পাতালে প্রবেশ। সিঁড়ি দিয়ে নামছি তো নামছিই। ধাপের পর ধাপে ঘরের পর ঘর। তিন-চার ধাপ নেমে আমার ঘর। তারও আবার আলাদা ছাদ। সে ছাদে নেমেছে পাহাড়ি শ্রাবণ।
ভোর হতে চমকে দেখি পুবের আকাশ অরুণ। কোথায় মেঘের ঘনঘটা? এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মেঘ। যেন দামাল ছেলে সারারাত দস্যিপনা করে সবক'টা খেলনা গুছিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি।
ম্যালের পাশ দিয়ে বেড় করে যে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এমন পরিষ্কার আকাশ, দেখা যাবে না কাঞ্চনজঙ্ঘা?
সকাল-সন্ধ্যেয় এই রাস্তাটায় অনেকে শরীরচর্চা করেন। বসার জায়গায় অনেকে ভালোবাসা চর্চা করেন। দু'দিন ধরে দেখছি। হঠাৎ তিনজন স্থানীয় মহিলা আমাকে দেখে বললেন, আরে তাড়াতাড়ি যাও, প্রথম ভিউ পয়েন্টে গিয়ে দেখো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে…
কি! কাঞ্চনজঙ্ঘা? উচ্চারণ করতে গিয়ে তোতলিয়ে গেলাম। যদি না বলে দেন?
একগাল হেসে একজন মহিলা বললেন, আরে হ্যাঁ হ্যাঁ… যাও যাও…
প্রথম ভিউ পয়েন্ট অবধি যেতে হল না। একটা বাঁক ঘুরতেই, চোখের সামনে হৃদিযন্ত্র থমকে গিয়ে বলল… চুপ!
বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লাগল। সত্যিই সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাশে গানের তালে তালে চলছে শরীরচর্চা। নারী-পুরুষ এক সঙ্গে সেকি নাচ নাচছে! কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পিছনে রেখে তাদের নাচ উপেক্ষা করে খুঁজলাম নির্জন জায়গা। কিন্তু সে যা শব্দের প্রাবল্য তাকে ছাড়িয়ে যায় কার সাধ্যি। অগত্যা সে শব্দকে উপেক্ষা করেই বসলাম। ক্রমে ভিড় বাড়ছে। অনেক স্থানীয় মানুষ দেখলাম হাত জোড় করে প্রণাম করছেন। কেউ কেউ ঘুমন্ত বুদ্ধের সঙ্গে সাদৃশ্যতা দেখাচ্ছেন। কোথায় জানি হাত, পা, পেট, মাথা। আমি ওসব দেখলাম না, আমার সামনে গিরিশৃঙ্গই শুধু। যা বিস্ময়ের, ভালোবাসার নয়। এই যে রাস্তার পাশে ফুটেছে পাহাড়ি ফুল, তার উপর বসে একটা প্রজাপতি… এই যে রাস্তার ধারে লোহার জালে পা আটকে নেচে নেচে, উড়ে উড়ে পাখিগুলো ডেকে যাচ্ছে… এই যে ভিজে পাহাড়ের পাথুরে কোল… এই যে মাটি বেয়ে চলা পতঙ্গ… এই আমার… ভালোবাসার। আমার বলতে যাবতীয় যা কিছু।
আবার যদি ইচ্ছা করো
===================
ফেরার পালা। রাতের ট্রেন, দার্জিলিং মেল। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে রওনা হওয়া গেল। বৃষ্টি নেই। একরাশ মন খারাপ শুধু। আবার সত্য হল, পাহাড় শোক হরণ করে। মন হালকা। কিন্তু খারাপ। এক-একটা বাঁক আসছে, রাস্তা ঢালু হচ্ছে, মন বলছে, ফিরে গেলে হয় না?
না হয় না। চাইলেই কি সব হয়? পাহাড় যদি আমার আপনজন হয় সে আবার ডাকবে। নিজের মানুষ ছেড়ে যায় না। দূরে যায়। দূর আবার কাছে আনে। কথাটা কাছের বা দূরের বলে নয়, কথাটা আত্মীয়তাবোধের। পাহাড় আবার ডেকো। আমি আসব। পাহাড় তীর্থ-প্রতিজ্ঞ। এ শব্দ রবীন্দ্রনাথের। যে প্রতিশ্রুতি রেখেছে। পাহাড় রেখেছে প্রতিশ্রুতি। পাহাড় রাখেও। শুধু যাওয়ার সময়টা সঠিক আমাদের জানা নেই। তেমন হলে শ্রাবণেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দাঁড়ায় চোখের সামনে, স্বমহিমায়। পাহাড় জানে আমার জন্য সঠিক সময় কখন। আমার শুধু ডাকের অপেক্ষায় থাকা।
(ছবি নিয়েছি বন্ধুদের। Amiya Biswas, Pradipta Nandy, Snehashis Bose, Prosenjit Aich, Subrata Chakraborty থেকে। অনেক ধন্যবাদ ছবিগুলোর জন্য।)